“সাগর পাড়ে জন্ম, সাগর পাড়েই এখন সংসার”মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি :: “সাগর পাড়ে জন্ম, শৈশবও কেঁটেছে সাগরের নোনা জল ও তপ্ত বালুচরে। আর সাগর পাড়েই এখন সংসার। সাগর পাড়ে কাজ করে এখন বেঁচে আছেন। হয়তো এই বালুচরেই কাটাতে হবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত”।

কুয়াকাটার সাগর পাড়ে গড়ে ওঠা শুটকি পল্লীতে রোদে শুকনো মাছ মাঁচা থেকে নামাতে নামাতে এ কথা বলেন চল্লিশোর্ধ ফুলবানু।

ফুলবানুর মতো এ শুটকি পল্লীতে কাজ করা পিয়ারা ও রহিমা বেগমের দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের আগে। কর্মব্যস্ততা শেষ হয় সূর্যাস্ত শেষে কখনও কখনও গভীর রাত পর্যন্ত। শুটকি পল্লীতে নিয়ে আসা কাটা মাছ মাঁচায় সাজানো ও শুকানো মাঁচা থেকে নামানো তাদের কাজ। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তারা এ কাজ করছেন।

কলাপাড়ার পশ্চিম কুয়াকাটা গ্রামের ফুলবানু সংসারে স্বামী ও চার সন্তান। স্বামী হাসেম মল্লিক শ্রম বিক্রি করতে করতে এখন অসুস্থ্য। বড় ছেলে রিয়াজ ৫ম শ্রেণিতে, মেঝ ছেলে রবিউল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে শাহ পরান ও মেয়ে শারমিনের এখন মায়ের কোলে বসে আদর খাওয়ার বয়স হলেও মায়ের মতো তাদের শৈশব এখন তপ্ত বালুচরে কাটছে।

ফুলবানু বলেন,“ আমাগো জীবনে আর পরিবর্তন নাই। মোর জন্মও এইহানে। হেই ভাগ্য নিয়ার জন্মাই না যে, একটু সুখের মুখ দেখমু। বাবার ঘরে থাকতেও মাছ বাছছি হেই ছোড থেইক্কাই। স্বামীর ঘরেও একই কাজ। কাজ না করলে খাওয়া জোটে না”। রোজ দেড়শ টাহা মজুরী পাই। হেইয়া দিয়াই চলে সবকিছু। হারাদিন মাছ বাছি, কিন্তু ঘরে রান্দি ডাইল, আলু। তাইলেই বোঝেন আমরা ক্যামন আছি। এইহানে কাজ না করলে ঘরে খাওন জোটত না। হয়তো শ্যাষদিন পর্যন্ত এইহানেই থাকতে হইবে।

এ ফুলবানুর মতো কলাপাড়া অন্তত ১০ টি জেলে ও শুটকী পল্লীতে অন্তত পাঁচ শতাধিক নারী ও শিশু মাছ বাছা ও শুকানোর কাজে জড়িত। কিন’ এই নারী শ্রমিকদের বেতন না বাড়লেও বেড়েছে কাজের সময়। গঙ্গামতি গ্রামের দুই সন্তানের জননী আকলিমা বেগম বলেন, এই গ্রামেই মোর জন্ম। বিয়াও হইছে এইহানে। আগে বাবায় মাছ ধরতো,আমরা হুগাইতাম। আর এ্যাহন স্বামী ধরে, মুই শুকাই। দিন বদলাইছে কিন্তু আমাগো কাজ আর ভাগ্য বদলায় না।

কাউয়ার চর গ্রামের সেলিনা বেগমের বয়স ৬০ পেড়িয়ে গেলেও এখনও মাছ শুকানোর কাজ করছেন। বার্ধক্যের কারনে এখন আর দূরে যেতে পারেন না তাই ঘরের সামনের উঠানেই তিনি জেলেদের কাছ থেকে অল্পদামে মাছ কিনে শুকিয়ে বিক্রি করেন। অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজ করছেন। তিনি বলেন, ছোড থেইক্কা এই হানে আছি। কত মানুষের উন্নতি দ্যাখছি। আগে যারা মোর বাবার কাছ থেকে মাছ কিইন্না বিক্রি করতো তারা এ্যাহন মাছের বেপারী হইয়া গ্যাছে। আর আমরা ২/৩’শ মানুষ হেই চরেই পইড়্যা আছি। হয়তো এইহানেই বালির মধ্যে মরতে হইবে।

কলাপাড়ার ধুলাসার, চরচাপলী, কাউয়ার চর, গঙ্গামতি, কুয়াকাটা, খাজুরা, পশ্চিম কুয়াকাটা, নিজামপুর, মহীপুর, আলীপুর চাড়িপাড়া, নাওয়াপাড়া গ্রামে হাজার হাজার নারী জন্ম থেকেই মাছ ধরা ও মাছ শুকানোর পেশায় জড়িত রয়েছে। কিন্তু বাড়েনি তাদের বেতন ও পারিবারিক উন্নতি। দারিদ্র ও অশিক্ষার কারনে এ নারীরা অধিকাংশই বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে প্রতিবেশী কিংবা পাশের গ্রামের কোন জেলে পরিবারের বউ হয়েছেন। তাই স্বামীর ঘরেও তাকে একই কাজ করতে হচ্ছে। এদের পল্লীতে নারী দিবস কিংবা কোন উৎসবের রং ছড়ায় না। অভাব ও দারিদ্রতার কারনে তাদের শ্রমের “ঘাম” এ ভিজে দিন শেষে স্বামী ও সন্তানের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার তৃপ্তির হাসি সকল উৎসব কিংবা দিবসকে ম্লান করে দেয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here