ডেস্ক রিপোর্ট::  মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলো ঝড় ও ব্যাপক ভারী বৃষ্টিপাতের শিকার হয়েছে। এর ফলে প্রাণঘাতী আকস্মিক বন্যার পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয়-ব্যস্ততম বিমানবন্দর তথা দুবাই বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

ফ্লাইট বাতিল-বিলম্ব ও যাত্রীদের নানা বিড়ম্বনার মধ্যে দুবাই বিমানবন্দরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলেছে, তারা ‘খুবই চ্যালেঞ্জিং অবস্থার’ সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া দুবাইয়ের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কিছু যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে না যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

আরও উত্তরে, বন্যার পানিতে গাড়ি পড়ে যাওয়ার পর একজন লোক মারা গেছেন। ওমানে উদ্ধারকারীরা সাহামে একটি মেয়ের লাশ খুঁজে পেয়েছেন। এতে করে গত রোববার থেকে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ১৯ জনে পৌঁছেছে।

বিবিসি বলছে, বুধবার গ্রিনিচ মান সময় রাত ৯টায় (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার ভোর তিনটায়) ফ্লাইট অ্যাওয়্যার-এর ডেটা অনুসারে, দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২৯০টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি সারা বিশ্বের যাত্রীদের জন্য ব্যস্ততম এয়ার হাব হিসেবে পরিচিত।

ডেটা অনুসারে, ওই একই সময়ে আরও ৪৪০টি ফ্লাইট বিলম্বিত ছিল। বিমানবন্দরটি গত বছর ৮০ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রীদের পরিষেবা দিয়েছে এবং যাত্রী পরিষেবার দিক থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সতর্ক করে বলেছে, পরিষেবা পুনরুদ্ধারে আরও ‘কিছু সময়’ লাগবে। এছাড়া বিমানবন্দর থেকে দেওয়া সর্বশেষ আপডেটে এয়ারলাইন্স থেকে নিশ্চিতকরণ ছাড়া ১ নং টার্মিনালে যাওয়া এবং বিমানবন্দরে ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন হচ্ছে এমিরেটস। এই সংস্থাটির সদর দপ্তরও দুবাইয়ে এবং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জনপ্রিয় এই পর্যটন শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীদের জন্য চেক-ইন স্থগিত করেছে তারা।

কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে, আরও বজ্রপাত, ভারী বৃষ্টি এবং শক্তিশালী বাতাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, অনেক নিচু এলাকা এখনও পানির নিচে রয়েছে।

৭৫ বছর আগে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে ওমানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত গত মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ করেছে। ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজি ঘোষণা করেছে, ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আল-আইন অঞ্চলের খাতম আল-শাকলায় ২৫৪.৮ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে বছরে গড়ে ১৪০-২০০ মিমি বৃষ্টিপাত হলেও দুবাইয়ে বছরে সাধারণত মাত্র ৯৭ মিমি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আর এপ্রিল মাসের মাসিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৮ মিমি। গত মঙ্গলবার ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা বিপজ্জনক হওয়ার কারণে অসংখ্য আগত ফ্লাইট সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

মূলত ঝোড়ো বাতাসের কারণে বিমানবন্দরটিতে ফ্লাইট ওঠানামায় বিঘ্ন ঘটে। এই অবস্থায় একের পর এক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট হয় বাতিল, নয়তো তার শিডিউল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের ভেতরেই প্লাবিত রানওয়েতে বিমানগুলো ট্যাক্সি করছে। এছাড়া বিমানবন্দরের পার্কিং লটে গাড়িগুলোকে অর্ধেক ডুবে থাকতে দেখা গেছে। এমনকি বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলোও পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

এছাড়া দুবাই মল এবং মল অব দ্য এমিরেটসের মতো ফ্ল্যাগশিপ শপিং সেন্টারসহ শহরের মূল অবকাঠামোগুলোও প্লাবিত হয়েছে এবং দুবাইয়ের অন্তত একটি মেট্রো স্টেশনকে গোড়ালি-গভীর পানিতে প্লাবিত হতে দেখা গেছে।

অনেক স্থানে রাস্তা ধসে পড়েছে, আবাসিক এলাকাও নিমজ্জিত হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে বাড়ির ছাদ, দরজা এবং জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেইসাথে দুবাইয়ে ১২-লেনের মহাসড়কের কোথাও কোথাও দীর্ঘ যানজটও দেখা গেছে।

বিবিসি বলছে, দুবাইয়ে মূল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকা পড়া বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ পর্যটকদের মধ্যে রয়েছেন কেট এবং অ্যান্ড্রু গোল্ডিং। তারা ১২ ঘণ্টা ধরে সেখানে ছিলেন। ৬২ বছর বয়সী অ্যান্ড্রু বিবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘আমি অন্য ফ্লাইটে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’

কেন্টের এই দম্পতি কেটের ৬০ তম জন্মদিন উদযাপনের জন্য দুবাইতে এসেছিলেন। আর এই ভ্রমণকে অ্যান্ড্রু বলছেন, তিনি ‘কখনও ভুলবেন না’।

অ্যান্ড্রু বলেন, ‘এখানকার অবস্থা আমার মনে হয় যে কারও প্রত্যাশার চেয়েও খারাপ, বিমানবন্দরের সিস্টেমটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে এবং এমিরেটস, যাকে আমি সেরা এয়ারলাইনগুলোর মধ্যে একটি বলে মনে করি – এখানে কোনও কর্মী নেই, কোনও তথ্য নেই, কোনও সমন্বয় নেই, কোনও পেশাদারিত্ব নেই, কোনও পরিষেবা নেই। এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে কী করতে হবে সেই দুর্যোগ পরিকল্পনাও এমিরেটসের নেই। এটি অদ্ভুত। বড় কোম্পানিগুলো সাধারণত এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য আগেই পরিকল্পনা করে রাখে।’

তার ভাষায়, ‘এখানে সম্পূর্ণরূপে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। লোকেরা লাউঞ্জে, মেঝেতে ঘুমাচ্ছে এবং খাবারের প্যাকেট সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এটি সত্যিই একটি সুন্দর নোংরা অভিজ্ঞতা।’

বিবিসি নিউজ অবশ্য এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য এমিরেটসের সাথে যোগাযোগ করেছে।

বিমানবন্দরের অন্য স্থানে দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের রদারহ্যাম থেকে আসা অ্যান উইং তার স্বামী এবং তিন সন্তানের সাথে লন্ডন হিথ্রোতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করছেন। তারা তাদের ১১:২৫ মিনিটের ফ্লাইটের জন্য স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় বিমানবন্দরে পৌঁছান এবং প্রাথমিকভাবে তাদের বলা হয়েছিল, ফ্লাইটটি এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে।

অ্যান উইং বলছেন, ‘আমরা আজ সকাল ৮টা থেকে এমিরেটসের কারও সাথে কথা বলতে পারিনি। যাত্রীরা সংযোগ ডেস্কে চিৎকার ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা করছিল, সেখানে কোনও স্টাফ ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি ভয়ঙ্কর, আমরা পশুদের মতো গাদাগাদি করে আছি – এটি বিপজ্জনক এবং অমানবিক। এটা এখানে একেবারেই হাস্যকর।’

তিনি বলেন, তার পরিবার দুপুরের খাবারের সময় থেকে খায়নি, এবং যা দেওয়া হয়েছিল তা হলো ‘ছোট কার্টনে কিছু পানি’।

দুবাই ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল নামে পরিচিত দুবাইয়ের অন্য একটি বিমানবন্দরে পাঠানো যাত্রীদের সাথেও বিবিসির যোগাযোগ হয়েছে, যারা একই রকম দৃশ্য এবং সঠিক খাবার ও পানির সংকটের কথা বর্ণনা করেছেন।

অবশ্য বৃষ্টিপাতের জেরে দুবাইতে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি, তবে রাস আল-খাইমাতে আকস্মিক বন্যায় গাড়ি ভেসে যাওয়ার পর একজন বয়স্ক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

যদিও মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে বৃষ্টি কমেছে, তারপরও দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তাদের কার্যক্রম আরও বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে এবং বলেছে, সেখানে প্রচুর মানুষের ভিড় রয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here