সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, ঝুট সেক্টর দখল,ভূমি দস্যুতাসহ ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারের ফলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থিত মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমানের চরম ভরাডুবি হয়েছে। শেষ মুহুর্তে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় ভোটের ব্যবধান হয়েছে এক লাখেরও বেশী। আওয়ামী লীগ প্রতাবশালী নেতা শামীম ওসমানের এই বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় কেন হলো? সেই প্রশ্ন করেন অনেকে। ৭ বছর দেশের বাইরে থাকা ,তার তাবেদার ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে ওঠা, জাতীয় পত্রিকা থেকে সাংবাদিকদের চাকুরীচ্যুত করা, হুমকী, বড় ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের হুমকী, লাগামহীন কথাবার্তা ও ভুমি দস্যুতা, মেঝ ভাই সেলিম ওসমানের শহরে সব ব্যবসায়ী, সামাজিক সংগঠনের নিজের পকেট কমিটি বানানো, অজাচিত হস্তক্ষেপ, ভাতিজা আজমেরী ওসমান ও ছেলে অয়ন ওসমানের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রভৃতি কারনে শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে শামীম ওসমানের শহরের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মহলের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক সময় সাংগঠনিক ক্ষমতার জন্য দলের ভেতরেই প্রশংসা ছিল ওসমানের। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে ৫/৭ হাজার লোক সমাগম করার পারদর্শিতা ছিল তার। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর দেশ ত্যাগ করেন শামীম ওসমান । ফিরে আসেন ৭ বছর পর ২০০৮ সালে আ’লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এ দীর্ঘ সময় দেশের বাইওে থাকায় এবং কোন পদে না থাকায় এক সময়ের কর্মীদের অনেকেই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ ৫ (সদর ও বন্দর) আসনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে সংসদ সদস্য হন তার বড় ভাই নাসিম ওসমান। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে বন্দরও একটি অবহেলিত জনপদ। গত তিন বছরে বন্দরে কোন উন্নতি হয়নি। নাসিম ওসমানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মানের। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরনে কোন অগ্রগতী নেই। এসব কারনে হতাশ হয়ে পড়ে বন্দরবাসী। নাসিম ওসমানের ছত্র ছায়ায় বন্দরে জাপা নেতা সানাউল্লাহ সানু ও বালু সন্ত্রাসীদের গডফাদার চাঁন মিয়ার নেতুত্বে একটি চক্র গড়ে ওঠে। যারা মেতে উঠে ভূমি দস্যুতায়, নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের মতো কর্মকান্ডে। তাই ভোটের হিসেবে তার প্রতি ফলন ঘটেছে। বন্দরে (সাবেক কদম রসুল পৌর সভা) ৪১টি কেন্দ্রের সব কটিতে ভরাডুবি হয়েছে শামীম ওসমানের। বন্দরে ভোটের সংখ্যা ৯৭হাজার ৫’শ ৮১জন। ডা: সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছেন ৫২ হাজার ৭’শ ৪৪ ভোট। শামীম ওসমান পেয়েছেন মাত্র ১৬ হাজার ৫’শ ৪১ ভোট। একই রকম ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরেও। নিজের কেন্দ্র গুলোসহ ভয়াবহ ফল বিপর্যয় ঘটেছে শামীম ওসমানের । শহরে ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৬২ হাজার ৮’শ ৫২ ভোট। ডা: সেলিনা হায়াত আইভী পেয়েছেন ৮১ হাজার ৯’শ৭৯ ভোট। আর শামীম ওসমান পেয়েছেন ২৪ হাজার ২’শ ২৯ ভোট।

এদিকে শামীম ওসমানের মেঝ ভাই সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ চেম্বার , বিকেএমইএ এবং নারায়ণগঞ্জ ক্লাব দখল করে বনে যান সভাপতি। তিন বছর যাবৎ শহরে যতো ব্যবসায়ী সংগঠন আছে, সব কটির কমিটি মূলত তিনিই বানিয়ে দিচ্ছেন। কোন সংগঠনের সদস্যরা নেতৃত্ব কিংবা নির্বাচনের সুযোগ পান না। বড় ভাই এমপি, মেজ ভাই নিয়ন্ত্রন করেন সব সংগঠন । তাই শামীম ওসমান যখন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন, তখন সাধারন মানুষ ভালো ভাবে নেয়নি। বিষয়টি তাদের কাছে মনে হয় সব কিছুই দখলে নিতে চায় ওসমান পরিবার। এছাড়া ৮ বছরে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র হিসেবে ডা: সেলিনা হায়াত আইভীর কর্মকান্ড ছিল চোখে পড়ার মতো। বড় ভাই নাসিম ওসমানের হুমকী ও লাগামহীন কথাবার্তা ও শামীম ওসমানের ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলেছে। তফসিল ঘোষনার পর নাসিম ওসমান স্থানীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আমরা নারায়ণগঞ্জ শক্তির দিক থেকে একচ্ছত্র। আমাদের বিরুদ্ধে দাড়ানোর মতো কোন শক্তি নেই। আইভী ৫ হাজার ভোটও পাবেনা। তার এসব কথাবার্তাও অনেককে বিরূপ করে তোলেন। এ ছাড়া পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, শামীম ওসমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন শহরের হিন্দু সমপ্রদায়ের কথিত নেতা চন্দনশীল ও গুপি নাথ দাস কর্তৃক তাদের লোকজনকে হুমকী, মন্দিরের মূর্তি সন্ত্রাসী দিয়ে ভাংচুর করিয়ে ডাঃ আইভীর ও জেলা বিএনপির সভাপতি  তৈমুর আলম খন্দকারের সমর্থকদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়া ও হিন্দু সমপ্রদায়কে শামীম ওসমানের ভোট ব্যাংক হিসাবে সনাক্ত করায় বিক্ষুদ্ধ করে তুলে এ সমপ্রদারের লোকজনকে।

ওদিকে ভোটের রাজনীতিতেও পিছিয়ে পড়ে শামীম ওসমান । বেসরকারী টেলিভিশন গুলোতে টকশোতে শামীম ওসমান ব্যক্তিগত আক্রমন করেন ডা: আইভীকে। আর আইভী শামীম ওসমান , তার ভাতিজা সন্ত্রাসীদের লালন কর্তা আজমিরী ওসমানের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। অনেকের মধ্যে ধারনা হয় দোর্দন্ড প্রভাবশালী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা রাখেন ডা: আইভী। তাই বিএনপি ও তার সমমনা দলের সমর্থকরা শামীম ওসমান বিরোধী হিসেবে ঝুকে পড়েন ডা: আইভীর দিকে। তারা ডা: আইভীকে এড: তৈমূরের চেয়েও নিরাপদ মনে করেন। যার ফলশ্রুতিতে ডা: আইভীর এই বিশাল বিজয় বলে অনেকের ধারনা।

অপরদিকে গডফাদার শামীম ওসমানের আ’লীগ রাজনীতীর সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি তাবেদার বাহিনী গড়ে। যাদের কাজ ছিল শামীম ওসমানকে সন্তুষ্টি করে আখের গোছানো। এদেও কারনে ক্ষুন্ন হয়েছে শামীম ওসমানের ভাবমূর্তি। জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়ে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জের এমপি ছিলেন শামীম ওসমান। কাজ করেছিলেন মোটামুটি। তাই সিদ্ধিরগঞ্জে শামীম ওসমানের অবস্থা ছিল নারায়ণগঞ্জ ও বন্দরের চেয়ে ভালো। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীর কারনে এখানেও ডা: আইভীর চেয়ে কম ভোট পেয়েছে শামীম ওসমান। সিদ্ধিরগঞ্জে ডা:সেলিনা হায়াত আইভী  পেয়েছেন ৪৫হাজার ৩’শ ২৩ ভোট আর শামীম ওসমান পেয়েছেন ৩৭হাজার ৯’শ৩৫ ভোট। এসব কারনে বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় ঘটেছে শামীম ওসমানের।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/মাকসুদুর রহমান কামাল/নারায়ণগঞ্জ

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here