সেলফি
জয়ন্ত বাগচী 

চলতে ফিরতে রাস্তা ঘাটে ,খবরের কাগজে , টিভিতে এমন কি বড় রাস্তার ধারে ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপনে শুধু একটা জিনিষের ছবির   রমরমা,তা  হল মোবাইল ফোন । দিনরাত রাতদিন চলছে কে কাকে
টেক্কা  দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা । কে পাঁচটা সুবিধা  দিল তো  সঙ্গে
সঙ্গে আর একজন ঝাঁপিয়ে পড়লো ছ’ছটা সুযোগ দিচ্ছে বলে । বাপরে বাপ ! কি
উন্মাদনা  গোটা দেশটা তা থৈ থৈ নৃত্য করতে শুরু করেছে  ঐ একটা পুঁচকে
যন্ত্র নিয়ে । আগে শুধু মনের কথা শোনার জন্যই ছিল আকুলি বিকুলি আর এখন
ছবি………ছবিতে ছবিতে একেবারে ছয়লাপ । পোজ দিতে গিয়ে  তো বেশ কটা শহীদ
হয়ে গেল । স্বাধীনতার জন্যে নয়, রাজনীতির জন্যেও নয়… হয়ে গেল সেলফি
শহীদ ! তারি মধ্যে আবার কে কাকে একদম এলোমেলো  করে  দিলো তাই নিয়ে প্রবল
আইনি লড়াই । এর মুণ্ডুতে ওর  শরীর জুড়ে দিয়ে যাচ্ছেতাই কেচ্ছা ছড়িয়ে
দিয়েছে জগতময়  ।

রিক্সায় প্যাডেল  মারছে আর কানে লাগানো ছিপিতে গান শুনছে । বাবু আমার বড়ে গোলাম আলি খান ! কি মগ্নতা ! যাবার কথা আমড়াতলা  আর নিয়ে এলো বেলপুকুরে ! কি ঝামেলা , কিছুতেই মানতে চায় না সে
ভুল করেছে !

বাজারে আনাজওয়ালা  ছিপি কানে এঁটে পটলের
জায়গায় উচ্ছে মাপছে  কেজি ভরে ।আরে আরে করিস কি ?কি দিচ্ছিস ? চাইছি দু
কেজি পটল আর তুই দিচ্ছিস উচ্ছে ? অতো উচ্ছে দিয়ে কি আমার শ্রাদ্ধের
শুক্তো রান্না হবে ?  কথা শুনে  ঝাঁঝিয়ে ওঠে – আপনি তো এটাই চাইলেন !
সকাল থেকে এতো মাল বেচলুম কোন ভুল হয়নি  আর আপনি বলছেন………

বাসে চলেছি রাতের বেলা । কোথায় এলো  জানলা দিয়ে
দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না ।  কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করতেই পাশ থেকে একজন
জ্যাকশন জ্যাকশন বলতে বলতে হুড়  হুড় করে নেমে গেল

আমি তো অবাক ! জ্যাকশন বলে আবার এই দিকে কোন জায়গা !  আগে তো কোনদিন
শুনিনি ! তবে কি ভুল বাসে উঠলাম ?  আবার  কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করতেই
ঝাঁঝিয়ে ওঠে – শুনেছি শুনেছি ,  চুপচাপ বসুন  ঠিক জায়গা এলেই  নামিয়ে দেব।

বাড়ি ফিরে  দেখি আমার গৃহিণীও কানে ছিপি লাগিয়ে
বিছানাতে বসে পা দোলাচ্ছেন আর চোখ বন্ধ করে টুক টুক করে ঘাড়টাও নাড়াচ্ছেন
! জিজ্ঞেস করলাম , হ্যাঁগো এটা আবার………

সন্তু এনে দিয়েছে । সারাদিন এফ এম  শুনবো ।
আমি বললাম , কি শুনছো  দেখি  আমি একটু শুনি,একটা  ছিপি আমার কানে দাও।

শুনেই তিনি  রে রে করে উঠলেন । ঐ তো তোমার  দোষ ।
আমার কোন কিছুই কি তোমার সহ্য হয় না ? শুনছি একটা গান , সেটাকে দুখানা
করে শুনলে আর কিছু থাকবে না বুঝবো ? আর কি বললে, ছিপি ?  তোমাকে নিয়ে আর
ভদ্র সমাজে চলাই যাবে না । কেন হেড ফোন বলতে পারো ।

সে কি  ! গান  দুভাগ হয়ে যাবে ?  দুকানের দুটো ছিপিতে
কি আধখানা করে গান হচ্ছে ?

আবার বলে ছিপি …  ও তুমি বুঝবে না । তুমি বসে বসে খবরের কাগজটা পড়।বলতে বলতে    ঘরের বাইরে চলে গেল ।

সেদিন সকালে ছাদে হঠাৎ  দুম করে শব্দ হল ।  কি পড়লো , কে পড়লো করতে করতে ছাদে  গিয়ে দেখি  নাতনি পায়েল পা  চেপে বসে আছে ,গলগল করে রক্তও বের হচ্ছে । কি রে কি হল  , কি করে হল ?

-দাদু আমার পা টা মনে হয় ভেঙেই  গেল …উফ মাগো…কেঁদে কেঁদে বলে পায়েল ।

-তা হল  কি করে  ?

পাশ থেকে ছোট নাতি টুটুল বলে  , কি হয়েছে জানতো দাদু , দিদি না টবের ঐ গোলাপ ফুলটার সঙ্গে  সেলফি  তুলবে বলে টবটা  সরাচ্ছিল আর সেটা পায়ে পড়েছে।

-সেলফি টবের গাছ নিয়ে ?

কাঁদতে কাঁদতে মিনমিনে গলায় পায়েল বলে , আজ  ফ্লাওয়ার্স –ডে , তাই ভাবলাম ফুলের  সঙ্গে … উফ মাগো…

-ব্যস  ! এখন চল ডাক্তারখানায় , সেখানে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে সেলফি তুলবি………

-না দাদু , আগে ছবিটা নিতেই হবে না হলে পোস্ট করতে পারবোনা যে! তুমি টবটা একটু তুলে দাও না প্লীজ…দাদু……

-এখনো সখ মেটেনি ?  ঐ ভাঙা টব তুলব  কি  করে  ?

– প্লীজ…দাদু , যা হোক  একটু ম্যানেজ করো । নাতনির আবদারে তুললাম টব । গোলাপের কাঁটায় হাত রক্তারক্তি  কিন্তু উপায় নেই ।এমন সময় বৌমার প্রবেশ ।  কি রে  পায়েল  কিসের যেন শব্দ হল ?

-ওমা…… তুই,গোলাপের সঙ্গে সেলফি তুলছিস ! বাবা  প্লীজ… আর একটু ধরে থাকুন না …
আমি একটা শট নিয়ে নি ……

কাকতাড়ুয়ার মতো  দাঁড়িয়ে থাকলাম গাছ ধরে । মা মেয়ে কিচ কিচ  করে সেলফি
তুলছে মত্ত হয়ে ।

-বৌমা হাত যে ব্যথা হয়ে গেল , এবার থামো !

-আর একটা বাবা ।  ও মা ,তাড়াতাড়ি আসুন ।  বাবা  কি দারুণ স্ট্যান্ড  দিয়েছেন দেখুন।থপ থপ করে আমার বাষট্টি বছরের গিন্নিও আসছেন পোজ দিতে  ! হায়রে …সেলফি

এখন নিজেকে মনে  হচ্ছে চিড়িয়াখানার সেই শিম্পাঞ্জি বাবু………। সবাই দেখছে আর ছবি নিচ্ছে………সেলফি !!

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here