জুঁই জেসমিন
জুঁই জেসমিন :: আসমান্ডা ঘুরছে বাপ,  ছোটো বেটা কহচে মোবাইল কিনে দে, স্মার্ট  ফোন, আর বড় মাই কহচে সাইকেল কিনে দে।  তোমহায় কহও চেয়ারম্যান সাহেব মি এলা কি করিম,,, গেরস্থিডা কেমনে হবে রোপালা পানি বেকড় মরে যাছে, তেলের যা দাম তেল কিনবা পারুনি
এদিক তোমহার ইলেকশন , সময়ও দিবা পারুনি ভাই।
.
প্রকৃতির ঋতু রঙে-
পারুল ফার্স্ট  ইয়ারে এখন ,  খুব পরিশ্রমী, ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে বেড়িয়ে পরে সবুজের আলিঙ্গনে মেঠোপথের শিশিরে দু পা স্নান করে-
এক পশলা সূর্য আভায় নিজেকে রাঙিয়ে ফিরে আসে ছায়ানীড়ে। কিন্তু আজ?  আজ সে চুপচাপ বসে অমিলের পাতা কুটিকুটি করে চলে ক্রমশ গৃহের মাঝে-!
আজ তার মন ভাল নেই! আজ নতুন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সব ছাত্রছাত্রী  সাইকেলে করে স্কুলে যায়- আর তাকে চার কিলোপথ হেটে স্কুলে যেতে হয়। অনেকেই তাকে যাওয়া আসার পথে সাইকেলে তুলে নেয় এটা তার কাছে অসহায় বা দয়া দয়া লাগে, কারো করুণা নিতে তার বড় আপত্তি,তারপরও জীবন চলে পরগাছা রূপে।  রোকন এস এস,সি দেবে। ক্লাস সেভেন থেকেই তার হাতে ফোন,  সারা বিশ্ব যেন তারই হাতে, ভাবসাব যেন লাটসাব,লাটসাব।
কিন্তু কয়েকদিন ধরে সে কাবু, জড়সড় অবস্থা ফোন খারাপ হয়ে যাওয়াতে।
.
পারুল বাড়ির কাজও করে, মুরগী ও ছাগল পালন করে। পড়ালেখার পাশাপাশি তার এ যেন শখের কাজ । সাদা কালো খাসি দুটো আর মোরগ তিনটে তার প্রাণ বন্ধু। সে খুব সুখি কিন্তু কষ্ট একটাই হেঁটে স্কুল কলেজ যাওয়া। পারুল বাড়ির কাজও করে,
 সে আনমনা রথে ভেবে বসে সাইকেল তার চায় কি চায় —
পারুলের মাথায় আরো অস্বস্তিকর এক ভাবনা, বন্ধু বান্ধবীর জন্মদিন বা বন্ধুর ভাই বোনের বিয়ে- বারো মাসে যেন তেত্রিশটা নিমন্ত্রণ -কাল তার বন্ধুর জন্মদিন,
.
মেধাবী হওয়াও বিপদ যেন এই সমাজ মঞ্চে- পারুল মেধাবী ছাত্রী তাই প্রত্যেকে তাকে দাওয়াত করে,
আর দাওয়াত মানেই উপহার দেওয়া ,এর জন্য লাগে টাকা–!
মাস বছরে এতো ডজন ডজন উপহার দেবেটা কে শুনি? যে বাপ ছেলের  বিলাস আবদার  পূরণ করতে মেয়ের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি দিতে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা, সে বাপের কাছে জন্মদিনের উপহার কিনে চাওয়া –
.
ওরে বাবাহ! যেন আমের মুখে তেতুল! পারুলের জীবনে  কোনো দাওয়াত আসা মানে ফাঁসির দড়ি সামনে ঝুলা।
সাইফুল হঠাৎ ঠোঁট চিবিয়ে কপাল কুঁচকে কিছু টাকা গুনতে গুনতে ঘরে ঢুকে –
 টাকাগুলো মুষ্টি বেঁধে নীরবতার বাঁধ ভেঙে চঞ্চল বর্ণধারায় মেয়ের হাতে টাকা দিয়ে বলে তোর পছন্দ মতো কিনে লিস, যত পারিস কমসমে লিস,কিছু টাকা বাঁচলে ধান খেতত পানি দেওয়া যাবে।”
পারুল লাফিয়ে উঠে খই ফোটা হাসিতে –
ঘরে লাফাতে থাকে টাকাগুলো বুকে চেপে!
পারুল খুশির ফোয়ারায় স্বপ্নিল চঞ্চলতায় যেন নতুন রূপে সাজে স্কুল যাওয়ার উদ্দেশ্যে –
.
সাইফুল ভালমন্দ জিনিস বেচাকেনা করতে জানেনা, তার কাজ শুধু আবাদ করা। সভ্য সমাজে  পরিবারের যা প্রয়োজন তা সব ছেলেই কিনে।
কিন্তু রোকন পারুলের সাইকেল কিনে দিতে নারাজ, সে চায়না তার বোন সাইকেলে করে স্কুলে যাক।
ক্রমশ পারুল ও তার বান্ধবীরা সবাই মিলে বাজারে যায় সাইকেল কেনার জন্য – বেশ দরকষাকষির মধ্যে শেষমেশ পাঁচ হাজার পাঁচশত নিরানব্বই টাকা দিয়ে সাইকেল নেওয়া হয়।
পারুলের জীবনে আজ এক নব আনন্দের দিন
নতুন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি যাওয়া – আকাশে খুশির ঢেউ দোল খেয়ে যায় নব ঋতুর শিরোনামে।
.
বাড়িতে এসে মুসুরির ডাল আর সিম আলুর ভাজা দিয়ে ভাত খেতে বসে,পারুল খেতে বসলেই সব মুরগী মোরগ তার চারপাশ ছুটোছুটি করে খাওয়ার জন্য। আজ সারা আঙিনা শূন্য- ব্যাপার কি?
পারুলের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে!
সে তার মাকে বলে– ” মা মা মোরগ মুরগী লা  কই, আর খাসি দুইডা,,, ওমা ও আল্লাহ্‌, খাসি দুইডা মোর কি হইল?হাউমাও কান্না-!
রোকন ঘর থেকে বের হয়ে বলে-
নতুন সাইকেল কি হাওয়াত আইসছে নাকি,,,
.
ছাগল মুরগী সব বিক্রি করে দিহু, কিছু টাকা দে সাইকেল আর বাকি টাকা সংসারের বাকি কামের জন্য!
পারুল ধপাস করে আঙিনায় বসে পড়ে! সে মুরগী ও ছাগল পালন করে, উপবৃত্তির টাকায়, তবে তা বিক্রির উদ্দেশ্যে না, এসব পোষ মানতে তার ভাল লাগে তাই——-!
পারুলের দাদি, কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়, নারী জীবনটাই সংগ্রামের,  এবং ত্যাগের,  নারীরা লালন করে বড় করে, আর পুরুষেরা তা অনুমতি ছাড়াই ভোগ উপভোগ করে।  হাজার হাজার নারী কাজ করে অর্থ উপার্জন করে, আর উপার্জনের মোটা অংক শেষমেশ পুরুষ কর্তার হাতেই – খবরদারি চলে।
নারীরা আগে ছিল গৃহ বন্দী আর এখন মুক্ত কর্মী হয়েও ভোগবঞ্চিতা হয়ে আছে,নিজে উপার্জন করেও ভোগ করতে পারেনা,নিজের স্বাধীনতা টুকু জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে নীলাভ নীলিমায়।
.
তোমার খাসি তোমার মোরগ বিক্রি করা হয় অথচ তোমার অনুমতিটুকু নেওয়া প্রয়োজনবোধ মনে করলনা —! যা তোমার দাদাও ঠিক আমার সাথে এমন করেছে-! আমার হাতের লাগানো সারিসারি গাছ বিক্রি করেছে, যদি কোনো রকম জানতে পারে আমার হাতে টাকা আছে, দেশী বিদেশী পারফিউমের মত আদর ভালোবাসায় আমার মন ভিজিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতো । আমি শহরে আছি দুই যুগের গর্ভে আরামের সীমানায়-কিন্তু সেই দিন গুলোর আঁচড়ে আজও ক্ষতবিক্ষত মন- আমাদের সময় উপায় ছিলোনা বা কোনো কথা বলার সাহসও ছিলোনা, কাঁদিসনা গুপ্ত ভোগীদের বদলানোর জন্য নিজেকে শক্ত হতে হবে বট বৃক্ষের মতো।
.
“আচ্ছা দাদি,সাইকেলের দাম সাড়ে পাঁচ হাজার  আর এতে দু দুটো বড় খাসি বিক্রি করে দিলো আমার, আবার মোরগ দুটোও ? একটা খাসিই তো গত ঈদে ১০ হাজার বিক্রি করেছিলো,, অথচ আমার সাইকেলের উদ্দেশ্যে এতোটা এভাবে,,,  এতো টাকা করবে কি বাপ ছেলে তবে?
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here