মোঃ আব্দুল্লাহ:: ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত শিল্প আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে বর্তমানে এর অবস্থা খুবই করুণ। যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে টিকতে না পেরে বিলুপ্তির পথে এখন প্রাচীন এই শিল্পটি।
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। হস্ত চালিত তাঁতে বছরে প্রায় ৭০ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয় যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ মিটিয়ে থাকে সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা।

তাঁতশিল্পের কথা বলতে গেলে যে সকল জেলার নাম আসে সিরাজগঞ্জ তাদের মধ্যে অন্যতম একটি জেলা। এ জেলা তাঁত বস্ত্র উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত। সিরাজগঞ্জ জেলার সাথে তাঁতের নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সিরাজগঞ্জ জেলায় তাঁতী পরিবারের সংখ্যা মোট ১৪,৮৭০ এবং তাঁত সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতিবছর এ জেলায় হস্ত চালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয়।সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁতীরা শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, থান কাপড়, থ্রি পিচ, গ্রামীণ চেক সহ বিভিন্ন প্রকার বস্ত্র উৎপাদন করে থাকে যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারত, ইন্দোনেশিয়া সহ অনেক দেশে রপ্তানি করা হয়।

দেশের অন্যান্য জেলার মতো সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁত শিল্পে নিয়োজিত অধিকাংশ লোক পল্লী এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের প্রচলিত ব্যবস্থা এখনও অত্যন্ত অসংগঠিত। জেলার কয়েকটি হাটে তাঁতীদের উৎপাদিত বস্ত্র বিক্রি হয়ে থাকে যার মধ্যে সোহাগপুর হাট, শাহাজাদপুর হাট, এনায়েতপুর হাট ও সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেট হাট উল্লেখযোগ্য । বিদ্যমান বিপণন ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্ত্বভোগী মহাজন, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা তাঁতীদের নিকট থেকে বস্ত্র ক্রয় করে। তাঁতীরা প্রত্যাশা করে তাদের উৎপাদিত তাঁত বস্ত্র বিক্রয় ও রপ্তানির মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের উন্নয়নসহ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। কিন্তু অবেহলিত তাঁতীদের সেই আশা অপূর্ণ থেকে যায়। ক্রমাগত সুতার মূল্য বৃদ্ধি, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধি এবং তাদের উৎপাদিত বস্ত্র সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সমস্যার কারণে তাঁতীরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। তারা ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। ফলে আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়েছে। তাই অনেকে তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পৌরসভার আওতাধীন অনেক এলাকারই অনেক তাঁতী এখন অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে। তাঁতীদের সুষ্ঠু সংগঠনের অভাব, মূলধনের অভাব, ন্যায্য মূল্যে মানসম্পন্ন উৎপাদন উপকরণ সহজলভ্য না হওয়া, প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাব, উৎপাদিত বস্ত্রের সুষ্ঠু বিপণনের অভাব প্রভৃতি তাঁত শিল্পের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে।

তাঁতিদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার উপজেলার বালসাবাড়ি গ্রামের তাঁতি ডেলভার ব্যাপারী কাছ থেকে। তিনি বলেন ‘অনেকটা নিরুপায় হয়েই বাপ-দাদার এ পেশায় আঁকড়ে রয়েছেন তিনি। বাজারে সুতা ও প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বেশি। সে তুলনায় উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা নেই। বেশি দামে কাঁচামাল কিনে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।’

একই গ্রামের তাঁতি ছামেলা খাতুনের কাছ থেকে জানতে পাওয়া যায়। ‘যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। যন্ত্রচালিত তাঁতে কম সময়ে বেশি পরিমাণ কাপড় বানানো যায়। সেগুলোর বুননও বেশ শক্তিশালী। এ কারণে অনেকেই হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদিত কাপড় কম পছন্দ করছেন। বাজারে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় তাদের টিকে থাকা বেশ কঠিন।’

সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁত শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও তাঁতীদের কল্যাণার্থে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তিনটি বেসিক সেন্টার এ জেলায় রয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, কামারখন্দ, কাজিপুর ও তাড়াশ উপজেলা নিয়ে বেসিক সেন্টার সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলা নিয়ে বেসিক সেন্টার শাহজাদপুর এবং উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলা নিয়ে বেসিক সেন্টার উল্লাপাড়া গঠিত হয়েছে, যা শুধু নামে গঠিত হয়েছে কিন্তু কোন কাজ ই করে না। উল্লেখিত ৩টি বেসিক সেন্টার হতে তাঁতীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী প্রকল্পের আওতায় ৩,৮৫০ জন তাঁতীর মধ্যে ৬ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ঋণ প্রদান করার কথা রয়েছে উক্ত ঋণ কার্যক্রম ১৯৯৯ সালে শুরু হয়ে অদ্যাবধি চলমান থাকার কথা রয়েছে কিন্তু ঋণ প্রদান করা হয়েছে খুবই কম সংখ্যক তাঁতিদের যা কদাচিৎ, এখান থেকে তেমন কোন সুবিধা পায় না স্থানীয় তাঁতিরা। তাদেরকে এখন কোন ঋন দেওয়া হয় না। শুধু মুখে শোনা যায় তাঁতিদের ঋন দেওয়া হবে কিন্তু কাজের বেলায় নাই।কাস্টমস হাউসে রক্ষিত সুতা স্বল্প মূল্যে বিভিন্ন তাঁতী সমিতিতে বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। বিভিন্ন দুর্যোগে কালীন বেসিক সেন্টার সাহায্য, সহযোগিতা নিয়ে তাঁতিদের সামনে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও তারা উপস্থিথ হয় না।

সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা এখন অনেক করুন অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করছেন।উৎপাদিত পন্যের যথাযথ দাম পাচ্ছেন না তারা, কাপড়ের চাহিদা খুবই কম।তাই অনেকে বাধ্য হয়ে তাদের পেশা বদলাচ্ছেন।
যারা এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদেরকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে উচ্চমূল্যের কাঁচামাল আর কমতির দিকে থাকা চাহিদার সঙ্গে। এসব কারণে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া এই পেশাটি।যারা এখনো টিকে আছেন, মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। যেকোন সময় তারাও এই পেশাটিকে চিরতরে বিদায় জানাতে পারেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here