ডেস্ক রিপোর্ট::  ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মোল্লারহাট ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের দুটি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্পের তদারকিতে থাকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সঠিকভাবে কাজ না করে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।

জানা গেছে, মোল্লারহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ কামদেবপুর বেপারী বাজার কালাদা খালের পূর্ব পাড় দিয়ে পলাশপুর বাজার ভায়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক বেপারীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনঃনির্মাণ ও ইটসলিং প্রকল্পে ২৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। ২০২২ সালের ১ এপ্রিল কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ওই বছরের ১৭ মে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন মোল্লারহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান সেন্টু। ওই সড়কে একই বছর দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার প্রকল্প আনা হয়। প্রকল্পের নতুন নাম দেওয়া হয় দক্ষিণ কামদেবপুর কাবিলের বাড়ির উত্তর পাশ দিয়ে মৌজে আলী বেপারীর বাড়ির জামে মসজিদ পর্যন্ত পুনঃনির্মাণ ও ইট সলিংকরণ। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি করা হয় ওই ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুম কামালকে।

প্রথম প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, বেপারী বাজার কালাদা খালের পূর্ব পাড় দিয়ে পলাশপুর বাজার ভায়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক বেপারীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনঃনির্মাণ ও ইটসলিং বাস্তবায়ন প্রকল্পের কমিটিতে চেয়ারম্যান সভাপতি আর আমাকে সেক্রেটারি করা হয়েছিল। কমিটি করার সময় বেপারী বাড়িতে বসে আমার কাছ থেকে একটি স্বাক্ষর নিয়েছে। এরপর কাজের সর্ম্পকে কোনো সমন্বয় করেনি, মাস্টার রোলে স্বাক্ষর করেনি। কীভাবে টাকা তুলেছে, কত টাকা তুলেছে, কখন টাকা তুলেছে তা আমাকে জানানো হয়নি। চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন, অনলাইন থেকে আমার ছবি ডাউনলোড করে প্রকল্প প্রস্তাবনা দিয়েছেন। আমিও তা জানতাম না।

তিনি বলেন, আমি দেখেছি চেয়ারম্যানের লোকজন এই সড়কে আগে যে ইট ছিল তা ট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেছে।

সাবেক ইউপি সদস্য ও ঠিকাদার দুলাল হাওলাদার বলেন, মোল্লারহাট ইউনিয়নের রাজবাড়িয়া খ্রিস্টানপাড়ায় এলজিইডি প্রকল্পে ২১শ ফুট সড়ক আমি সংস্কার করেছি। যখন সড়কের কাজ শুরু করেছি তখন ইট সলিং পেয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন, সড়কের ইট যেন আমি না ধরি। ইট সে তুলে নিয়ে যাবে। পরবর্তীতে সে ইট তুলে নিয়ে যায়।

এছাড়া ওই ইউনিয়নের গোপালপুর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির আওতায় মধ্য কামদেবপুর গ্রামে তিন কিলোমিটার খাল খনন করে এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়। ওই তিন কিলোমিটারে খাল খননে এবং বেড়িবাঁধে দুই বছরে পৃথক দুটি প্রকল্প অনুমোদন করান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। প্রথম দফায় খাল খনন প্রকল্প, পরের বছর বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রকল্প। এর মধ্যে খাল খনন করে সেই মাটি রাস্তায় ফেলে তা পরবর্তী প্রকল্পের কাজ হিসেবে দেখানো হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফারুক হোসেন বলেন, খাল খনন করেই রাস্তা বাঁধানো হয়েছে। শুনেছি এখানে বেড়িবাঁধ প্রকল্পও এসেছে। কিন্তু কাজ একবারই হয়েছে। খাল কেটে রাস্তা বাঁধানো হয়েছে।

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, এখানে শুধু খাল কাটা হয়েছে। রাস্তার আলাদা কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি।

বৈশাখিয়া টিএইচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোতাচ্ছিম বিল্লাহ বলেন, মধ্য কামদেবপুরে সলিমের বাড়ির এখানে রাস্তার উন্নয়ন আলাদাভাবে হয়নি। ওখানে খাল কেটে মাটি তুলে তা দিয়েই রাস্তা করা হয়েছে।

খাল খনন প্রকল্পের সভাপতিও চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান সেন্টু। এভাবে সরকারি বরাদ্দের প্রতিটি প্রকল্পে অনিয়ম করে তিনি টাকা তুলে নেন অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মধ্য কামদেবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, এলাকার উন্নয়নের নামে সরকারি টাকা লোপাট করে নিয়ে যাচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান সেন্টু। উন্নয়ন বরাদ্দ এনে তিনি যে কাজগুলো করেছেন সেগুলোতে অনিয়ম হয়েছে। এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হলে তার অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসবে। আমি ঝালকাঠি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে সচিবালয়ে চেয়াম্যানের অনিয়মের বিষয়ে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

এড়িয়ে যাচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ

এসব অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় এলজিইডি নলছিটি উপজেলা প্রকৌশলী ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। ইকবাল হোসেন বলেন, আমি কোনো বিষয়ে কথা বলতেও পারব না তথ্যও দিতে পারব না। কোনো বিষয় দরকার হলে আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা করুন।

গোপালপুর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির আওতায় খাল খনন আর বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের তথ্য চেয়ে এই কর্মকর্তার কাছে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক গাজী আরিফুর রহমান। তথ্য অধিকার আইনের আবেদন গ্রহণ করলেও এই কর্মকর্তা কোনো তথ্য দেননি বলে জানান আরিফুর রহমান।

একটি প্রকল্পের বিনিময়ে নিজ দপ্তরে বসে প্রকৌশলী ইকবাল হোসেনের ঘুষ গ্রহণের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন না তিনি। অভিযোগ রয়েছে, মোল্লারহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এই কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা রেখেই অনিয়ম করেন।

দক্ষিণ কামদেবপুরে একই সড়কে দুটি প্রকল্পে কাজ না করে বাস্তবায়ন দেখানোর বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বীজন কুমার খরাতির সঙ্গে কথা বললে তিনিও ব্যস্ততার কথা বলে ওই প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
বিজন কুমার খরাতি বলেন, আমি বাইরের কাজে যাচ্ছি। ঠিক কখন আপনাকে (প্রতিবেদক) সময় দিতে পারব তা বলা যাচ্ছে না। তাছাড়া এই প্রকল্প চলতি বছরের না। যেটি পুরাতন প্রকল্প তা নিয়ে নতুন করে কথা বলার কিছু নেই।

যা বলছেন মেম্বার-চেয়ারম্যান

অভিযোগের বিষয়ে একটি প্রকল্পের সভাপতি ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মাসুম কামাল বলেন, একই সড়কে দুটি উন্নয়ন বরাদ্দ এসেছে। আমরা কাজ করে তারপর টাকা নিয়েছি। আসলে যারা অভিযোগ তুলছেন তারা ইউনিয়নের এক বিদ্রোহী প্রার্থীর প্ররোচনায় বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান আর আমাদের বিপদে ফেলতে এই কাজ করছেন। এগুলো পূর্ব শত্রুতা। কাজ সঠিকভাবেই হয়েছে।

মোল্লারহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান সেন্টু বলেন, আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের যে অভিযোগ তুলেছেন সেই আবেদনকারী হচ্ছেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভাগনে। বর্তমানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে। নির্বাচনে আমার ভাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আমার ভাই আলহাজ আমির হোসেন আমুর আশীর্বাদপুষ্ট নন। যে কারণে একটি পক্ষ আমাকে বিপদে ফেলতে এসব অভিযোগ-অনিয়মের কথা বলছে।

তিনি বলেন, যতগুলো প্রকল্প এসেছে তার সবগুলোতে সঠিকভাবে কাজ হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিদর্শন করেই বিল দিয়েছেন। অনিয়ম করলে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার মানসিকতা আমি রাখি

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here