ডেস্ক রিপোর্ট : : সৌদি সরকারের আর্থিক অনুদানে ২০০০ সালে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ঘোষবাগ ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০ শয্যার আধুনিক ‘চর আলগী হাসপাতাল’।

হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পর ঘোষবাগের প্রায় ৩৬ হাজার ও আশপাশের আরও ১৪-১৫ হাজার লোকের চিকিৎসাসেবায় আধুনিকায়ন আসার সম্ভাবনা থাকলেও গত ২০ বছরেও তার কোনো উন্নতি হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। জনগণের সেবা দেয়া তো দূরের কথা উল্টো নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে হাসপাতালটি।

অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটিতে নিয়মিত থাকেন না কোনো চিকিৎসক বা সেবিকা। রোগিদের জরুরি সেবার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও দেখা যায়নি সেটি। সম্প্রতি অ্যাম্বুলেন্সটি করোনার নমুনা পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান দায়িত্বরতরা।

কর্তৃপক্ষের দাবি জনবল, ওষুধ, পানি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকট এবং হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতলটির ২০ বেড খালি পড়ে আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বেডই অনেক দিন ব্যবহার করা হয়নি। দোতলার হাসপাতালটির বেশির ভাগ কক্ষে ঝুলছে তালা। নিচতলার বহির্বিভাগে একজন অফিস সহকারী, একজন ওয়ার্ডবয়, দ্বিতীয়তলায় একজন মেডিকেল অফিসার ও একজন সেবিকাকে দেখা যায়। কোনো রোগী না থাকায় অলস সময় পার করছেন তারা। ২০ বেডের কোনটাতেই ভর্তি নেই কোনো রোগী।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত ব্যবহার না থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে ও ইসিজি মেশিনসহ মূলবান আধুনিক যন্ত্রপাতি। এ ছাড়াও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) সকল মূল্যবান যন্ত্রপাতি পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ওটি’টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে একবারও ব্যবহার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

হাসপাতালের বাইরে দেখা যায়, ভবনের সিঁড়িতে পড়ে আছে কর্তব্যরত চিকিৎসকের লেখা কয়েকটি ওষুধের স্লিপ। স্থানীয়রা বলছেন, হাসপাতাল থেকে ওষুধ না দেয়ায় রোগীরা স্লিপগুলো ফেলে দিয়ে গেছে। বড় রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা ছোটখাটো কোনো রোগের চিকিৎসা করতে এলেও তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ পাওয়া যায় না। স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালটির কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকারও অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে অবগত আছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে একজন আরএমও, পাঁচজন মেডিকেল অফিসার, ছয়জন সেবিকা ও চারজন ওয়ার্ডবয়সহ ৩২জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়ে যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। যার মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৫ জন। আর চিকিৎসা সেবায় একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার, একজন মেডিকেল অফিসার, একজন সেবিকা বর্তমানে হাসপাতালে আছেন। এদের মধ্যে জরুরি সেবায় আছেন মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার ও একজন সেবিকা।
প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে রোগিরা আসেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। আবার বড় ধরনের কোনো সমস্যা হলে রোগীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা সদর হাসপাতালে চলে যায়।

অজ্ঞাত কারণে এ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের আগ্রহ নেই বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, চলতি বছর মার্চ মাসের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আবাসিক ও বহির্বিভাগে এক হাজার ১৭২জন রোগি আসেন। যার মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৩২ জন রোগী। সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল একজন রোগি ভর্তি হওয়ার পর ৮ এপ্রিল ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেছেন।

স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, গত কয়েক মাস আগে তার তিন বছরের শিশু বাচ্চার পেটে সমস্যা নিয়ে চর আলগী হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কর্মরত চিকিৎসককে দেখানোর পর তিনি দেখে কোনো ওষুধ না দিয়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন।
ওই ব্যবসায়ির অভিযোগ তার বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বললে ওই চিকিৎসক জানান, পাঁচ বছরের কম বয়সী কোন রোগীতে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না। একই অভিযোগ করেন স্থানীয় আরেক ব্যক্তি। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন তার স্ত্রী। বাড়ির পার্শ্ববর্তী হাসপাতাল হওয়ায় এখানে নিয়ে আসেন তাকে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে চট্টগ্রাম নিয়ে যান নিজের স্ত্রীকে। বর্তমানে চট্টগ্রামে তার চিকিৎসা চলছে।

স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালটি নামেই শুধু। এখানে থাকে না কোনো চিকিৎসক, দেয়া হয় না কোনো চিকিৎসাসেবা। কোনো রোগী হাসপাতালে আসলে তাদের সেবা না দিয়ে বসুরহাট, কবিরহাট ও মাইজদীতে নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক নিয়োগ কাগজে কলমে থাকলেও তারা নিয়মিত আসেন না। কয়েকজন মাঝে মাঝে আসলেও হাসপাতালে ১-২ ঘণ্টার বেশি থাকেন না। আরএমও বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আসেন আবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চলে যান। হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালু করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।

হাসপাতালে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. মহিবুল আলম জনবল সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, জনবল ছাড়াও পানি সংকট, চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট, বিদ্যুৎ সমস্যা, জেনারেটর মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও শুরু থেকে চিকিৎসা সেবা উন্নতি করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ জন রোগীকে আমরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। যার মধ্যে ৫-৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, জরুরি রোগী যারা আসছেন আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিকটস্থ উপজেলা হাসপাতালে স্থানান্তর করছি। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমান যন্ত্রপাতি থাকলে হয়তো এমনটা করা লাগত না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জানান, হাসপাতালটির বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ইতোমধ্যে আমরা অবগত হয়েছি। জনবল সংকটের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ওষুধের সমস্যটি সমাধান করা হবে। অতিদ্রুত হাসপাতলটির জন্য ইসিজি মেশিনের ব্যবস্থা করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি হাসপাতালটিতে পুনঃস্থাপন করে জনগণের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, বাইরের ওষুধ ব্যবসায়ী বা পল্লী চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here