চট্টগ্রাম: দু’বছরের প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে যন্ত্রণার অনলে পুড়ছিলেন রায়হান। এর মধ্যে তিন মাস আগে সায়মার জীবনে আসেন নতুন প্রেম।

এটা সহ্য করতে না পেরেই নিজ হাতে প্রিয় মানুষটিকে খুন করেন তিনি। আর সেই কাজে বাধা দেয়ায় খুন হতে হয় মা রেজিয়া খাতুনকেও।

রায়হন শুধু সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ব্যর্থ হয়েই একাজ করেনি সায়মার জীবনে নতুন করে বর্তমান প্রেমিক মির্জা নামক এক যুবক প্রবেশ করায় প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। রোমান্টিক তরুণ হয়ে যায় ঘাতক।

ভালোবেসে সায়মার নাম খোদাই করে নিজের হাতে লিখেছিল রায়হান। তবে নিজ দোষে প্রেমিকার কাছে ধরা পড়েন ভিলেন রূপে। আর তখন থেকেই রায়হানকে এড়িয়ে চলা শুরু সায়মার। যখন ভাঙা প্রেম জোড়া লাগানোর জন্য রায়হানের ডাকে সাড়া দেয়নি সেই ভালোবাসার মানুষটি তখন আর প্রেমিক মনটি উড়ে গিয়ে ঘাতক রূপে আর্বিভূত হয়েছে সায়মা ও তার মার সামনে। আর শেষ পর্যন্ত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সোমবার সকালে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় সায়মাদের বাসায় ঢুকে কুপিয়ে ও পায়ের রগ কেটে খুন করে মা-মেয়েকে।

নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় নিজ বাসায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েসহ মা খুনের ঘটনায় আটক রায়হান স্বীকারোক্তিতে এ বর্ণনা দিয়েছে। বুধবার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

নৃশংস এ খুনের ঘটনায় ইউএসটিসির বিবিএর ছাত্র রায়হানকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া তার সহযোগী শহিদ ড্রাইভারকেও। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের দু’দিনের মাথায় পুলিশ রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলো।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (ডিবি) বাবুল আক্তার জানান, বিভিন্ন উপায়ে খুনির অবস্থান নিশ্চিত হয়ে মঙ্গলবার দিবাগত রাতেই ঢাকার ফকিরাপুলের একটি হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মূল অভিযুক্ত আবু রায়হানকে। পরে তার দেয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বুধবার ভোরে চট্টগ্রামের খুলশি থানার শহীদ মীর্জা লেইন থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কিলিং মিশনে অংশ নেয়া রায়হানের সহযোগী ড্রাইভার শহিদকে। শহিদকে ডবলমুরিং থানায় পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং রায়হানকে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রামের পথে রয়েছে। তবে তাদের বহনকারী গাড়িটি পথিমধ্যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আটকে গেছে। তাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিএমপি সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে।

ঢাকার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া নগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই সন্তোষ চাকমা বলেন, গ্রেপ্তারের পর খুনের কথা স্বীকার করেছে রায়হান। এ কিলিং মিশনে শহিদ ও রায়হানই অংশ নিয়েছে। মূলত প্রেমের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ব্যর্থ হয়ে রায়হান প্রতিহিংসা পরায়ণমূলক এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রায়হানের বরাত দিয়ে ডিবি সন্তোষ চাকমা জানান, রায়হানের বন্ধু শহিদ খুলশী এলাকায় একটি গেস্ট হাউসের গাড়িচালক। রায়হান নিয়মিত ওই গেস্টহাউসে যেতেন এবং এর সুবাদে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। প্রায় দু’বছর আগে রায়হানের সঙ্গে কিশোরী সায়মা নাজনীনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সায়মা স্কুলে যাওয়ার পথে এবং হালিশহরে এম স্কয়ার এলাকায় পরস্পরের দেখাসাক্ষাৎ হতো। শহিদ যে গেস্টহাউসের গাড়ি চালায়, রায়হান বেশ কয়েকবার সায়মাকে নিয়ে ওই গেস্টহাউসেও গেছে।

তিনি আরো জানান, কিন্তু সম্প্রতি রায়হান খারাপ সঙ্গে পড়ে নষ্ট হওয়ার পথে পা বাড়ায়। বখাটে হয়ে বিভিন্ন মেয়ে নিয়ে রায়হান ওই গেস্টহাউসে যাওয়া-আসা শুরু করে। বিষয়টি জানার পর সায়মা তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। রায়হান বারবার অনুরোধে করেও সায়মাকে আর ফেরাতে পারেনি। সম্প্রতি সে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য সায়মাকে চাপ দিতে শুরু করে। এর প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। গত ২২ জানুয়ারি থেকে রায়হানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর সায়মার জীবনে নতুন করে আসে মীর্জা নামের একজন। আর এই খবর রায়হানের কানে পৌঁছামাত্রই ক্ষুব্ধ রায়হান এক পর্যায়ে খুনের পরিকল্পনা করে।

সন্তোষ চাকমা আরো জানান, প্যান্টে রক্ত লাগার কারণে শহিদ ওই বাসায় পোশাক পাল্টে একটি লুঙ্গি পরে বেরিয়ে যায়। খুনের পর ওই বাসা থেকে রক্তাক্ত শার্ট-প্যান্ট ও একটি ব্যাগ উদ্ধার করে সিআইডি। তবে রায়হান ঘটনার আগের দিন বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যাগ নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে বের হয় বলে তার পরিবার পুলিশকে জানায়।

এই জোড়া খুনের মামলা তদন্তে সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গোয়েন্দা) বাবুল আক্তার খুনি রায়হানের দুই বন্ধু ও সায়মার বর্তমান প্রেমিক মীর্জাসহ মোট ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরমধ্যে আটক বাড়ির দুই নিরাপত্তারক্ষী বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত সোমবার (২৪ মার্চ) সকালে নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কের ১২৯ নম্বর যমুনা নামের একটি ভবনের চতুর্থ তলায় মা রেজিয়া আক্তার (৫০) ও মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী সাইমা নাজনীনকে (১৬) রগ কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here