হীরেন পন্ডিত

হীরেন পণ্ডিত:: বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভবিষ্যতে কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ১০০ গ্রামকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। সেগুলোকে ডিজিটাল গ্রামে পরিণত করা হবে এবং ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। নাটোরের সিংড়া উপজেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ধানের বীজ ও সার বিতরণ অনুষ্ঠানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব তথ্য জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

কৃষিতে ব্যাপক উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ১০০টি ডিজিটাল গ্রামে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেখানে মাটির গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য আমরা ইন্টারনেট অব থিংস, প্রযুক্তি ডিভাইস ব্যবহার করবো। পশু পালন, মৎস্য চাষে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ড্রোন, বিগডাটা, ইন্টারনেট অব থিংস এবং কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা (এআই)—এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরচ কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে আমরা গবেষণা নিশ্চিত করে, প্রযুক্তি ব্যবহার করতে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছি।’

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করে ১৭ কোটি মানুষের চাহিদা মিটিয়ে সারা বিশ্বে কৃষিপণ্য রফতানি করার চেষ্টা করা হবে বলে জানান জুনাইদ আহমেদ পলক।

প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ঘটছে মানুষের চিন্তা-চেতনার, ফলশ্রুতিতে পাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। পৃথিবীতে গত কয়েক দশকে জীবনযাত্রা ও মানুষের চিন্তার যে বৈপ্লবিক বিকাশ ঘটেছে তা তার পূর্ববর্তী কয়েক শতকের পরিবর্তনের চেয়েও অনেক বেশি ও দৃষ্টান্তমূলক। অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতো কৃষি ক্ষেত্রের পরিবর্তনটি অনেক বেশি স্পষ্ট।

ধানসহ সব খাদ্যশস্য, সবজি, ফল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে আমাদের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে কৃষক আজকের উৎপাদন সাফল্য অর্জন করেছে। এর পেছনে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের যেমন প্রভাব রয়েছে। একইভাবে রয়েছে কৃষকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ করে কৃষক নিজস্ব প্রচেষ্টায় কিছুটা বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে ফসল বৈচিত্র্য সৃষ্টির পেছনে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে দেশে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচগুণ। ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ওই রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। দেশে খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি একটি নিশ্চয়তার জায়গায় পৌঁছে গেছে। এখন কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যের প্রশ্নে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে সামনে রয়েছে।
কৃষির বহুমুখী উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ব্যক্তি উদ্যোগের অনেক বড় অবদান রয়েছে। দেশি-বিদেশি গবেষণা সমন্বয়, উন্নত বীজ ও চারার ব্যবহার, কৃষক প্রশিক্ষণ ও উন্নত বাজার কাঠামোর কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে কৃষকের সচেতনা বৃদ্ধিতে উন্নয়ন সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষির প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। গত এক দশকের চিত্র যদি তুলে ধরা হয়, পৃথিবীর উন্নত দেশ থেকে যেসব কৃষি অনুশীলন তুলে আনা হয়েছে, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা কৃষক সেই অনুশীলনেই মনোযোগী হয়েছে। বলা বাহুল্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবগুলো আমাদের দেশের কৃষিতে পুরোপুরি পড়তে শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞরা যেভাবে বলছেন, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনও হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা সবকিছু। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে।
এখন পৃথিবীতে নতুন নতুন যেসব কৃষিযন্ত্র আসছে তাতে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস। বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে জমি চাষে। জমি চাষে ৯৫ শতাংশ কলের লাঙ্গল ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে ধান মাড়াইয়ে ৯৫ শতাংশ মাড়াই যন্ত্র বা থ্রেসার ও সেচ ব্যবস্থায় ৯৫ শতাংশ পাওয়ার পাম্প ব্যবহার হচ্ছে। কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে ধীরগতিতে। ফসল তোলা বা হার্ভেস্ট-এ ১.৫ শতাংশ, রোপণে দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। তবে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের হার দিনে দিনে বাড়ছে। আমাদের দেশের কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদিত যন্ত্রের সঙ্গে আইওটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের পুষ্টি নিরাপত্তার প্রশ্নে বহুমুখী সাফল্য সূচিত হচ্ছে। আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও খামারিদের কল্যাণেই আমাদের মৎস্য খাতে বিস্ময়কর সাফল্য সূচিত হয়েছে।
প্রযুক্তির আধুনিকতর উদ্ভাবন আইওটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও জরুরি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষির বাণিজ্যিকায়নে বহুমুখী সাফল্য থাকলেও কৃষিক্ষেত্রে বড় এক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটি হচ্ছে উৎপাদক শ্রেণির অনুকূল বাজার কাঠামো। এটি আজও পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। যে কারণে কৃষিক্ষেত্রে ফসল বৈচিত্র্য ও উৎপাদনের হার বাড়লেও কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য এখনও পাচ্ছে না।

এটি কৃষকের বহুযুগের এক সংকট। যেটি সমাধানে আজও পর্যন্ত কার্যকর ও টেকসই কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। প্রচলিত বাজারব্যবস্থার চাপে কৃষক প্রতি ফসলের মৌসুমের শুরুতে কিছুটা মূল্য পেলেও পরে লোকসান গুনে থাকে। বছরে চারটি ফসল করতে পারার সুবাদে কোনো কোনো এলাকার কৃষক পুষিয়ে উঠতে পারেন।

কৃষকরা এবং উৎপাদনকারীরা অবিশ্বাস্যরকম ঝুঁকি নেয় তাদের প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে কখন রোপন করতে হবে, কখন সেচ করতে হবে, কখন রক্ষার কাজে থাকতে হবে, কখন খাবার দিতে হবে এবং কখন ফসল গোলাজাত করতে হবে। ডিজিটাল টেকনোলজির উপর কৃষকদের আস্থা কম হলেও এই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে অন্যান্য সেক্টরগুলো উন্নতি করছে এবং এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। ডিজিটাল টেকনোলজির উপর কৃষকদের অনাস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির অভাব, যার মাধ্যমে কৃষকরা তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবে। এসব টেকনোলজির অনেকগুলোই ব্যবহার করা জটিল বলে কৃষকরা আগ্রহী হন না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কৃষি ফার্মে ইন্টারনেট অব থিংসের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে কৃষকরা তাদের কৃষিকাজের জন্য উপকারী তথ্য পাচ্ছেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কৃষিকাজে ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরি করছে যা খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকদের অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত কমিয়ে আনতে পারবে এবং কৃষকদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here