ইকবাল রাশেদীন

অঙ্কুরোদ্গম, রক্তজবার মতো বউ এবং সমান্তরাল পৃথিবীর গল্প

ইকবাল রাশেদীন

 

সূচনা পর্ব

সুজাত আলীর আজ ঘুম ভাঙ্গে সূর্যের সাথে। মোরগ ডাকছে, আবছায়া চারিদিক। আলনা থেকে গেঞ্জিটা গায়ে চড়িয়ে ক্ষেতের কাজে বেড়িয়ে পড়ে সে। যে জমিতে আজ লাঙ্গল দিতে হবে সেটি বাড়ি থেকে আধমাইল দূরে। বিরান মাঠের মধ্যে এই ভুঁইখানি। জমিতে কাজ করবার সময় জনমানুষের সাথে সারাদিন দেখা বা কথা বলবার সুযোগ কম। দূরে দূরে আরও কিছু জমিতে ফসল ফলাবার প্রস্তুতি চলছে তবে এইসময় সবাই যার যার কাজে সারাদিন নিমগ্ন হয়ে থাকে। বড় যাদের জমি সেখানে একাধিক লোককে কাজ করতে দেখা যায়, সেখানেও সকলে সারাদিন নিশ্চুপ কাজ করে চলে।

লাঙ্গল পর্ব

আয়তক্ষেত্র বিঘা খানেক ভূমিটিকে আজ সারাদিন লাঙ্গল দিয়ে চষে ফেলবার কাজ করছে সুজাত আলী। প্রাণী বলতে সে আর একজোড়া বলদ গাই। জমিতে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে চাষ করছে সে। মাঝে মাঝে – ‘এই থাক থাক বাঁয়ে’ ছাড়া তেমন আওয়াজ শোনা যায় না। যায় না বললে একেবারে ভুল বলা হয় – কাছে দূরে রয়েছে মাঠচর পাখিদের কলরব। সুজাত আলী লক্ষ্য করে – একটি বুলবুলি সেই সকাল থেকে তার সাথে সঙ্গ দিয়ে চলেছে। হুক্কা টানতে লাঙ্গল-জোয়াল ছেড়ে আইলের কাছে এলেই বুলবুলিটি গরুর কাঁধের উপর উড়ে এসে বসছে। গরু আদর করে লেজ নাড়িয়ে দিতেই বুলবুলিটি বি কুইক কুইক… করে ডেকে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে অন্য গরুটির কাঁধে বসে খেলা করছে।

দুপুর হয়ে এলে গামছা দিয়ে বাঁধা ভাতের গামলা এবং টিনের জগ ভরা পানি মাঠের কোণ থেকে তুলে নিয়ে সুজাত আলী জমির পূর্ব পাশে চলে আসে। সেখানে পিতামহের লাগানো কয়েকটি বড় বড় তাল গাছ সারাবছর ছায়া দিয়ে রাখে। সরসর করে অনবরত বাতাস এখানে তালপাতায় হুমড়ি খেয়ে হিমেল বাতাস তৈরি করে। হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে ভাতের গামলা উন্মোচন করে সুজাত। মাঠে কাজ করতে করতে এইসময় বেশ ক্ষুধা পায় তার। মোটা ভাতের সাথে আজ রয়েছে কাঁচা কুমড়োর চিংড়ি ঘন্ট। আগামীকাল পান্তা দিতে বলবে বউকে। পান্তা খেলে বেশ একটা আমুদে ভাতঘুম হয়। তাল গাছের ছায়ায় দূর্বাঘাসের ওপর গামছা বিছিয়ে ভাতঘুম দিতে সুজাতের ভালো লাগে।

মই পর্ব

গতকাল সারাদিন লাঙ্গল দিয়ে জমিটি চষে ফেলেছে সুজাত। আজ লাঙ্গলের বদলে গরুর পিঠে জোয়ালের সাথে মই বাঁধা। লাঙ্গলের চাড়ে উঠে আসা বড় বড় মাটির চাইয়ের উপর সে আজ ক্রমাগত মই দিয়ে চলেছে। বাম থেকে বামে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে মই দিচ্ছে সে। মই দেবার কাজটি লাঙ্গল দেবার চেয়ে সহজ। জোয়াল থেকে নেমে আসা দড়িটা ধরে মইয়ের উপর শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেই চলে। গরু মইকে টেনে নিয়ে চলে অবিরাম। আয়তক্ষেত্রের কোণের কাছে এলে লাগাম বায়ে টেনে ধরে বলতে হয় – ‘এই থাক থাক বাঁয়ে।’ বড় আয়তক্ষেত্রটি ক্রমান্বয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ছোটো হয়ে আসে। বারংবার মই দিয়ে মাটিকে ঝুরঝুরে করতে না পারলে জমি বীজ গ্রহণে সদাশয় হয় না। মানুষের শরীরের সাথে জমির, নাকি জমির শরীরের সাথে মানুষের তুলনা করবে ভেবে পায় না সুজাত। গতকালকের বুলবুলিটি আজও রয়েছে আশেপাশে। এরই মধ্যে জুটি জুগিয়ে ফেলেছে – নতুন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে তার পাশে পাশে উড়ছে। পুরোটা মাঠ এক চক্কর মই দেয়া শেষ হলে হুক্কায় তামাক সাজাতে বসে সুজাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয়ে পানিতে গরগর শব্দ তুলে হুক্কায় তৃপ্তির টান দিয়ে সে ভাবে – ‘আজকালকের মধ্যে বুলবুলি জোড়াটি আশেপাশে কোথাও বাসা তৈরি করে ফেলবে। ফসল কাটবার সময় মাঠে এসে হয়তো দেখা যাবে, ছানাপোনা নিয়ে উড়ছে দলবেঁধে।’

দুপুর হয়ে এলে গামছা দিয়ে বাঁধা ভাতের গামলা এবং টিনের জগ ভরা পানি মাঠের কোণ থেকে তুলে নিয়ে সুজাত আলী জমির পূর্ব দিকে চলে আসে। সেখানে তালগাছের ছায়ায় মিষ্টি বাতাস। কাছে দূরের পতিত জমিতে ঘাস, ঘাসফুল, লতাগুল্মে ভরা। পাশের জমিতে পশ্চিম পাড়ার কেউ পেঁয়াজের আবাদ করেছে। সেখান থেকে টান দিয়ে একটি পেঁয়াজের কালি তুলে নেয় সুজাত। পান্তাভাত মুখে দিয়ে পেঁয়াজের কালি কামড়াতে ভালো লাগে তার। হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে ভাতের গামলা উন্মোচন করে একটু হতাশ হয় সে! তবু পান্তাভাতের বদলে সেখানে গমের খিচুড়ি দেখে পরক্ষণেই আবার ভালো লাগে তার। পেঁয়াজের কালি কামড়ে খিচুড়ি খেতে খেতে সে ভাবে – ‘বাড়িতে বউকে নানা কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়, নিশ্চয়ই পান্তার কথা সে ভুলে গিয়ে থাকবে।’

 

বুনন পর্ব

গতকাল মই দিয়ে জমিটি বপনের উপযোগী করে ফেলেছে সুজাত। মাটির দলাগুলি প্রায় ডালিমের দানার মতোন আকার নিয়েছে। ফসল বুনবার আগে জমিতে আলতো করে স্পর্শ করে সুজাত। এই স্পর্শ মাটির সাথে, জমির সাথে কথোপকথন তার। সুজাত মাটির উর্বর শরীরকে স্পর্শ করে যেন বলে, ‘অনাদিকাল যেমন করে শস্যে-ফসলে ধরাকে বাঁচিয়ে রেখেছ, তেমনি রেখো তুমি আরও অনন্তকাল।’ জমির সাথে কথাপর্ব শেষ করে দাঁড়িয়ে কাঁধের গামছাটি কোমরে শক্ত করে বাঁধে। বাম হাত দিয়ে বীজপাত্রটি জড়িয়ে ধরে ডান হাতের মুঠোয় বীজ নেয় সুজাত। বাম থেকে ডানে বীজ ছড়িয়ে দিতে থাকে সে। মুঠোর বীজ ফুরিয়ে এলে পুনরায় বীজ নিয়ে সতেজ মাটির বুকে ছড়িয়ে দিতে থাকে মুঠো মুঠো শস্যদানা। কাছে-দূরের জমি থেকে মানুষের অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে। বিরান মাঠে ফসল বপনের বিভিন্ন আয়োজন চলছে। হুক্কা টানতে আসা বিরতিতে লক্ষ্য করে সুজাত – বুলবুলি দুটি পাশের ক্ষেতে কাউনের ডগায় নেচে নেচে খেলা করে যাচ্ছে। কখনো বা লেজের গভীরে লুকিয়ে থাকা লাল ঝুঁটি উন্মোচন করে ‘পি কুইক কুইক’ স্বরে সঙ্গীকে বিমোহিত করবার কসরত করে যাচ্ছে।

দুপুর হয়ে এলে গামছা দিয়ে বাঁধা ভাতের গামলা এবং টিনের জগ ভরা পানি মাঠের কোণ থেকে তুলে নিয়ে সুজাত আলী জমির পূর্ব পাশে চলে আসে। ভাতের গামলা খুলেই আজ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে সুজাতের চোখ! পান্তা ভাতের সাথে কয়েকটি কাঁচালঙ্কা ও পেঁয়াজ রয়েছে সেখানে। লঙ্কা-পেঁয়াজ মেখে আরাম করে পান্তা খায় সুজাত। খাবার পর ভাতঘুমে চোখ বুঁজে আসবার সময় জাতিস্মরের মতো মনে হয় সুজাতের – ‘ঠিক এমনি ঘটেছিল যেন কবে! ঠিক এমনই। দূর্বাঘাসের জমিনে চোখ বুঁজে এসেছিল কবে! পান্তা ভাত খেয়ে নেশার মতো বুঁজে এসেছিল দু’চোখ। এই জীবনের কথা যেন নয়, অন্য জীবন, অন্য কোনো গ্রহের জীবন হবে!’ সুজাত যেন জানে, একটু পরেই দূরের মাঠে শোরগোল শুরু হবে। ভীষণ শোরগোলের সাথে মারামারি শুরু হয়ে যাবে পূর্ব পাড়ার সাথে পশ্চিম পাড়ার। নিরানি হাতে সুজাতও এগিয়ে যাবে পূর্ব পাড়ার দিকে। নানাদিক থেকে কাজ ফেলে রে রে করে এগিয়ে আসবে অগণিত লোক। একটি মসৃণ নিরানি তার পেট ফালাফালা করে দেবে উপর্যুপরি আঘাতে। কলকল করে তরমুজ রঙের রক্তে ভেসে যাবে তার মাটিরঙের শরীর। তাজা খুন দেখে নিমেষে হই হই করে মাঠ ছেড়ে আতঙ্কে পালিয়ে যাবে সবাই। সুজাত জানে, আজ এই নির্জন মাঠে নিহত হবে সে। এই ভবিতব্য জেনে মৃদুহেসে তাল গাছের নরম ছায়ায় দূর্বাঘাসের জমিনে নিশ্চন্ত ঘুমে তলিয়ে পরে সুজাত।

উপসংহার

ভাত ঘুমের মধ্যে সুজাতের বউ কোথা থেকে যেন এসে ডাকতে থাকে। সুজাতের যেন ঘুম কোনোভাবেই ভাঙতে চায় না। ভীতসন্ত্রস্ত সুজাতের বউ ডেকে ডেকে বলতেই থাকে – ‘কই শুনতে পাচ্ছো না? একটু পরেই ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে, জলদি ওঠো, পালাও।’

– ঘুমের মধ্যে পাশফিরে সুজাত বলে, ‘আজ আমি নিহত হবো একথা পূর্বনির্ধারিত। একটু পরেই মাঠের শোরগোলের দিকে ছুঁটে যাবো আমি। কাস্তে দিয়ে কেউ একজন ফালাফালা করে দেবে আমার দেহ। লাল তরমুজের মতো রক্তে ভেসে যাবে সারা শরীর। বউ তুমি বাড়ি যাও।’

– তন্দ্রার মধ্যে সুজাতের বউ আরও ঝুঁকে আসে সুজাতের দিকে। লাল শাড়িতে এই সবুজ ফসলের মাঠে বউকে টুকটুকে একটি জবা ফুল মনে হয় সুজাতের। সবুজ পাতার ভীড়ে যেন ফুলটি সদ্য ফুটে উঠেছে। এদিকে ভীতসন্ত্রস্ত সুজাতের বউ হাত বাড়িয়ে সুজাতের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘তুমি ওঠো। তুমি পালাও। তুমি জলদি পালাও।’

– সুজাত জানে, পালিয়ে কোনো লাভ হবে না, এ ভবিতব্য। আজই নিহত হবে সে। বউয়ের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তাকে কেমন ঘুমের মধ্যেও আনন্দিত করে তোলে। বিষণ্ণকন্ঠে তবু সে বলে ওঠে, ‘এমন ঘটবে আমি তা জানি। আমার মতো এমন অনেক সুজাত আলী রয়েছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা গ্রহ থেকে গ্রহে। তারাও সকলে আজ তাদের নিজ নিজ জমিতে বীজ ছড়িয়েছে। তাদের সকলেই আমার মতো পান্তাভাতে নুন আর কাঁচামরিচ ডলে ভাত খেয়েছে। তারা সকলেই সেই তৃপ্তির আহারের পর গাছের শীতল ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু আমি তাদের থেকে একটু বেশি যা জেনেছি তা হলো, এই ঘটনাটি এখনই ঘটবে। ভাতঘুমে যাবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে আমি তা জানতে পেরেছি।’

ঘুমের মধ্যে সুজাত তার বউয়ের কন্ঠ পুনরায় শুনতে পায়। বউ উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে থাকে, ‘সুজাত, এসব কথা ঠিক আছে সে আমিও জানি। তবে আমি এ-ও জানি – তুমি তা ফিরিয়ে দিতে পারবে। আজ লক্ষ লক্ষ সুজাত আলী তাদের গেঞ্জিটি সোজাভাবে পড়ে মাঠে কাজ করতে বেরিয়েছে, শুধু তুমি সেই কাজটি তোমার অজান্তে করে উঠতে পারোনি। ভোর রাতে তোমার পরনের গেঞ্জিটি আলনাতে আমি সযতনে উল্টো করে রেখে দিয়েছিলাম। আমার বদলে দেয়া সুক্ষ্ম এই পরিবর্তন প্রকৃতি লক্ষ্য করতে পারেনি। লক্ষকোটি বছর প্রকৃতি আমাকে দিয়ে তার মানবজাতিকে রক্ষা করে চলেছে। আজ আমারও প্রকৃতির কাছে কিছু চাইবার দিন এসেছে।’

– ঈষৎ তন্দ্রা ঘোরে কেমন আশাবাদী হয়ে ওঠে সুজাত। বউয়ের আত্মবিশ্বাস দেখে কেমন সত্যি বলে মনে হয় তার। সুজাত ঘুমের মধ্যে বউয়ের আশাজাগানিয়া সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কীভাবে বাঁচাবে তুমি আমাকে?

– তুমি ঘুম থেকে জাগো। গেঞ্জিটা উল্টোকরে যেভাবে আছে সেভাবেই পরা থাকবে। ঘুম থেকে জেগে কোনোভাবেই শোরগোলের দিকে তাকাবেনা তুমি। কাউন আর আখ ক্ষেতের মাঝ দিয়ে দৌড়ে পূর্ব পাড়ার দিকে ছুটতে থাকবে তুমি। ঘরে না ফেরা অব্দি একটুও থামবে না কোথাও। এসো, ওঠো, দেখবে বাড়ির উঠোনে তোমার জন্য প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি।

– ভাত ঘুম ভেঙে যায় সুজাতের। শরীর জড়িয়ে আছে মিহি ঘামে। সুজাত তাকিয়ে দেখে, এরই মধ্যে মাঠে শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। সকলের হাতে লাঠি কিংবা অন্য কোনো অস্ত্র। শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখে সুজাত, ঠিক, উল্টো করেই পরা রয়েছে তার মলিন গেঞ্জিটি। খুশি হয়ে ওঠে সুজাতের মন, কাঁপুনি দিয়ে ওঠে ওর শরীর। তালগাছের নীচে সুজাত ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যায়। ভেজা ভেজা গেঞ্জিতে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে সুজাত। শোরগোল যেন বাড়তে থাকে চারিদিকে। কাউনের ক্ষেতে বাতাস দোল খায়, মাথা নুইয়ে নুইয়ে যেন ডাকছে আখের ডগা। দৌড় শুরু করবার পূর্বে আকন্দ গাছের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ দূর্বাঘাসের পথটিকে একবার দেখে নেয় সুজাত। চোখে ভেসে ওঠে রক্তজবার মতো লালশাড়ি পরা আবছায়া প্রিয় বউটির মুখ।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here