২৭ নভেস্বর, ২০০৯ সালের এই দিনে ভোলার লালমোহনে ঈদের আগের দিন কোক-৪ লঞ্চ দূর্ঘটনায় র্মত্যূবরন করেছিল ৮২ জন যাত্রী। আমিও ছিলাম ঔ লঞ্চের যাত্রী। আল্লাহুর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে যাই। এই দিনটির কথা মনে পরলে আমি আজও অসি’র হয়ে উঠি। আমার চোখে ভেসে উঠে সেই কালো রাতের কথা। দুই বছর পার হতে চলেছে কিন’ আজও লালমোহনবাসী জানতে পারলনা দূর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা শাসি- পেয়েছে কিনা। জানতে পারল না তদন- রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে কিনা। অপরাধীদের শাসি- না হওয়ায় তাই এখনও নৌ পথে চলছে চলাচলের অনুপযোগী লঞ্চ। দূর্ভোগ ও দূর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে সাধারন যাত্রীরা।

সেদিন সকাল ১০.৩০ টার সময় কোকো-৪ লঞ্চটি ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আমি লঞ্চের ২য় তলায় সিংগেল কেবিন নিয়ে লঞ্চটিতে যাত্রার শুরু করি। লঞ্চে মালামাল না থাকায় যাত্রীদের হাটাহাটির কারনে  লঞ্চটি একবার ডানদিকে আবার বাম দিকে হেলেদুলে চলতে থাকে।  কিন’ লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন প্রকার দৃষ্টি না দিয়ে লালমোহনের উদ্দ্যেশে চলতে থাকে। লঞ্চটি বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে আসার পর কিছু যাত্রী নৌকা করে নেমে যায়। আমি ও একবার নেমে যাওয়ার চিন্তা করেছিলাম। কিন’ দিনের লঞ্চ ভ্রমন করার ইচ্ছায় আর নামতে পারিনি।

লঞ্চটি বড় ছোট অনেক নদী পাড়ি দিয়ে যখন ভোলা সীমানায় প্রবশ করল তখন কিছুটা ভরসা পেলাম। আমার ৭ নং কেবিনে সহ সকল কেবিনের সামনে বিছানার চাদর বিছিয়ে সাধারন যাত্রীদের গাদাগদি অবস’ানের কারনে কেবিন থেকে বের হতে অনেক সমস্যা হত। কেবিন থেকে বের হয়ে নিচে যাওয়ার মত কোন যায়গা ছিল না। যখন যাত্রীদের হাটাহাটির কারনে  লঞ্চটি একবার ডানদিকে আবার বাম দিকে হেলেদুলে চলতে থাকে তখন লঞ্চের আনছার বাঁশ দিয়ে পানি ছিটিয়ে যাত্রীদের লঞ্চের বাম ডানে হাটাহাটি বন্ধ করার চেষ্টা করে। লঞ্চটি দেউলা ঘাট এবং বদরপুর ঘাট করে নৌকার মাধ্যমে কিছু যাত্রী নামিয়ে দেয়। লঞ্চটি নাজিরপুর টার্মিনালের কাছে এসে টার্মিনালে ঘাট না করে একটু দুরে ঘাট করে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটু পরিমান পানিতে যাত্রীদের নামাতে থাকে। কারণ জানতে পেলাম যাত্রীরা জীবন রক্ষার্থে দ্রুত নামার চেষ্ঠা করার সময়  ইন্সপেক্টর উজ্জল  লঞ্চের প্রধান ফটক বন্ধ করে টিকিট চেক করতেছে। কেবিন বয়  আমাকে এবং আমার পাশের কেবিনের লোকদের বলেন” লঞ্চের অবস’া ভাল না, আপনারা নাজিরপুর ঘাটে নেমে যান।

আমি  কেবিন থেকে লাগেজ নিয়ে রেলিং দিয়ে লঞ্চ ডুবে যেত দেখে আমি লঞ্চ থেকে নামার জন্য একটু সামনের দিকে আগানের চেষ্ঠা করতেই দেখি সকল যাত্রী তাড়াহুড়া করে বাদিকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আমিও ঝাঁপ দিতে গিয়ে যখন দেখলাম লঞ্চটা বাদিকে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে আমি ঝাপ না দিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। লঞ্চটা কাঁত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল আমি ” লা ইলাহা ইল্লালরাহু আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জলেমিন” পড়তেছিলাম। চোখের পলকে কি হয়ে গেল আমি বলতে পারব না। কিছুক্ষন পর পানি হতে ডুব দিয়ে উঠে দেখি আমি এক কেবিনে আটকা পরেছি। চারিদিকে অন্ধকার, শুধু আত্মচিৎকার শুনতে পাচ্ছি, আমিও বাচাও বাচাও বলে চিৎকার করছি আর কেবিনের চারপাশে হাত দিয়ে আঘাত করছি। আমার শরীর কোমর পানিতে ডুবে আছে। আমি আমার পকেট থেকে মোবাইটা বের করে দেখি তা ভিজে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। মোবাইটা চালু করার চেষ্টা করলাম। কিন’ পারলাম না। ২০-২৫ মিনিট পর শিশু ও মহিলাদের আত্মচিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভাবলাম আমি বুঝি আর বাচবনা। আল্লাহুর নাম স্মরন করতে থাকি। আর আত্মচিৎকার করতে থাকি। হাতের কাছে কেবিনের খাটের উপর বিছানো কাঠ নিয়ে বিভিন্ন স’ানে আঘাত করতেছি। পাশের কেবিন থেকে বন্ধু মারূফ বললো সোয়েব তুই কোথায়, আমি বললাম, আমি পাশের কেবিনে, মারূব বলল আমি ও আটকা পড়েছি। আমি দোয়া দুরুদ পড়ছি আর আত্মচিৎকার করছি। এক সময় পুলিশের বাঁশির শব্দ শুনে পুলিশ ভাই আমাকে বাচান বলে, আত্মচিৎকার করছি, আবার এলাকাবাসি কেউ আছেন আমাকে বাচান বলে আত্মচিৎকার করছি। একসময় এক লোক এসে বলল এই রুমে কেউ আছেন ? আমি বললাম, ভাই আমি আছি আমাকে বাচান, লোকটি একটি সাবল দিয়ে কিছুক্ষন চেষ্ঠা করে চলে গেল। আমি কিছুটা হতাশ হলাম।

আবার আত্মচিৎকার করতে থাকলাম। বেচে থাকার আসা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কেবিনের খাটের আরার উপর বসে আমি আমার বাবা ও মায়ের কথা, আমার বোন, ভাই  স্ত্রীর কথা ভাবতেছি আর অঝর ধারায় কাঁদছি। আমার শারা শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে, মনে হয়েছিল আমি আর বাঁচবনা, আমি আমার শরীরের ব্ল্লেজার, জামা, এবং পায়ের জুতা খুলে ফেলি। পায়ের নিচের মাটি কেটে শুরঙ্গ তৈরী করে বের হওয়ার পরিকল্পনা করি। কাছাকাছি কিছ মানুষের কণ্ঠ শুনে কেবিনের জোরার ঝালাই করার স’ানে দুই হাত এক করে জোড়ে বাচাও বাচাও বলে আত্মচিৎকার করি। এক লোক বলতেছে এই রুমে জীবিত লোক আছে। আমি আমার মাথার উপরে কাঠ দিয়ে আঘাত করলাম তারপর কেবিনের জোরার ঝালাই করার স’ানে কিছটা ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল বের করে দেখালাম আমার লোকেশন। উদ্ধারকারীরা আমার আঙ্গুল দেখে এগিয়ে আসে। কেউ বলে সাবল নিয়ে আয়, কেউ বলে হাতুরী নিয়ে আয়। আমি ভরসা পেলাম।

৪/৫ জন লোক যখন আমাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছে আমি দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আল্লার নাম জপতে লাগলাম। অক্লান্ত পরিশ্রম করে লোকেরা যখন কেবিনের এক কোণার পাত কাটতেছে আমি শুধু অধির আগ্রহ এবং এক বুক আশা নিয়ে ফালফাল তাঁকিয়ে রইলাম আর তাদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। দীর্ঘক্ষন চেষ্ঠা করে তারা একটু ফাক করে টর্চের আলো দিয়ে আমাকে খোঁজার পর আমি হাত উচিয়ে আমাকে দেখালাম। তারা আমাকে উদ্ধার করার মত ফাঁক করে আমাকে বলল আপনি হাত উচু করে আমাদের হাত ধরেন আমরা আপনাকে টেনে তুলব। আমি হাত দিয়ে তাদের হাত ধরলাম, তারা ৪ জন আমার দুহাত ধরে আমাকে আস্তে আস্তে টেনে তুলতেছে আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে, আমি বেচে আছি। আমি উপরে উঠার পর উদ্ধারকারীদের জরিয়ে ধরে কান্না করলাম। তখন কাউকে চিনতে পারলাম না। দু’জন আমাকে ধরে লঞ্চ থেকে নামিয়ে একটি জেলে নৌকাতে উঠালো।

মো: সোয়েব মেজবাহউদ্দিন

soyeb4@gmail.com

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here