মাহমুদা হক মনিরা :: “তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি, আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী, আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে, জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে, দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।”

দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ৮ ফাল্গুন, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। সেদিন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলো বাংলার দামাল ছেলেরা।
২১ ফেব্রুয়ারী প্রথম প্রহর, বাঙালী জাতির জন্য এক আবেগঘন মুহূর্ত। গ্রাম থেকে শহর শহীদের স্মৃতি স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে কোথাও যেন কোনো ফারাক নেই। ২১ ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের ভোর সাজে এক নতুন রঙে। স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে ফুটে উঠে ভাষা ও শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সরষে ক্ষেতের পাশে কলা গাছের তৈরি শহীদ মিনারে গাধা ফুলের মালা, শুধুই শ্রদ্ধা নিবেদন নয় বরং এতে মিশে থাকে বাঙালির আবেগ। ভোরের শিশির বিন্দু ঘাসে দলে দলে খালি পায়ে শিক্ষার্থীদের হেটে চলা মনে করিয়ে দেয় এই যেন শহীদ বরকত, আকবর, জব্বার, সালাম আবারও রাজপথে নেমেছে, আবারও বলছে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই’। শহরের ইট পাথরের স্তম্ভগুলোও যেন এই দিনে প্রাণ ফিরে পায়। প্রতিটি বালি কণা একসুরে গেয়ে উঠে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। ভাষা আন্দোলনের সাথে তরুন প্রজন্ম ভীষণভাবে জরিত। সেদিন তরুণদল এগিয়ে এসেছিলো বলেই আজ আমরা মায়ের ভাষায় নিজের কথা বলতে পারছি। আজও এই বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষাকে রক্ষা করতে নতুন প্রজন্মের ভুমিকাই সবচেয়ে বেশি।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, “একুশে একুশ হয়ে একুশের চেতনায় হাটছি, তাই একুশ নিয়ে ভাবনাটাও আমার কাছে একটু ভিন্ন। ইতিহাস তো অনেক পড়েছি কিন্তু ক’জনই বা সেই আত্মত্যাগের ইতিহাসকে অনুভব করতে পেরেছি। তাদের আত্মত্যাগের কারনেই আমরা বাঙালি জাতি আজ বিশ্বদরবারে সমাদৃত। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং নানান রকম অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত কিছু সংখ্যকই আমরা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করছি। অন্যদিকে অনেকে আবার আধুনিক হতে গিয়ে নানান ভাষার সংমিশ্রণে পরিবর্তন করে ফেলছি বাংলা ভাষার স্বাদকে অনন্য রাখতে উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় জোরদার হতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে, অন্যথায় বাংলা ভাষার মৃত্যু অবসম্ভাবী। বাঙালী জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভাষার প্রতি সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।”

সরকারি তিতুমীর কলেজের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, ২১একটি সংখ্যা নয়,২১ একটি চেতনার নাম,একটি উদ্ভাবনার নাম।২১ শুনলেই ফিরে যাই আমরা অতীতে,দেশ সৃষ্টির আগে যখন কেড়ে নিতে চেয়েছিলো আমাদের মুখের ভাষা,মায়ের ভাষা।১৯৪৭ সালে যখন দেশ বিভাজন হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র হয়,আমরা পরে যাই পাকিস্তানে,পাকিস্তানে ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান, আমরা বাঙালি তখন ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের আওতাধীন।পাকিস্তানিরা তাদের উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে চায় এবং আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় কিন্তু আমার মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে নারাজ ছিলো আমার বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা।আস্তে আস্তে এই ভাষা মতবাদ কঠোর রুপ ধারণ করে এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তারা নিজের তাজা রক্ত, বুলেটের কাছে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তৈরি করে নতুন ইতিহাস। ছিনিয়ে আনে আজকের স্বাধীন বাংলার মায়ের ভাষা মাতৃভাষা, বাংলাভাষা।আমি মনে এই ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার বীজ বপণ করে।৫২এর ২১ আমাদের চেতনা যুগিয়েছিলো আমরা পরাধীন থাকবো না,আমরা আমাদের মতো করে বাঁচবো।বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে আমি বলতে চাই,তাদেরকে ইতিহাস, ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে,তাদের জানতে হবে আমরা পরাধীন থেকে কিভাবে স্বাধীন হয়েছি,ভাষা থেকে দেশ নিজেদের করে নিয়েছি,তরুণ প্রজন্ম নেতৃত্ব দিবে আগামী।
তারা যেন এ সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ২১ চেতনায় এগিয়ে যায়।সবার জন্য থাকবে আমার অফুরন্ত ভালোবাসা।”

বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি এর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আরিফ রাফি বলেন, “৫২’র ভাষা আন্দোলন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরী করে দিয়েছিল।বাঙালি জাতি স্বত্বায় স্বাধীনতার বীজ বপণ করে দেয় এই আন্দোলন। কিন্তু বর্তমানে এটা শুধুই আমাদের গর্ব নয় বরং এখন এই দিনটিতে আন্তআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পুরো বিশ্বে পালন করা হয়।বাঙালি তরুন প্রজন্মকে আজকে গোটা বিশ্ব চিনছে,আমাদের পূর্বোশরিদের এই মহান ত্যাগের জন্য।তাই আমারা আজো খালি পায়ে,কুয়াশা ঢাকা পথ ধরে শহীদ মিনারে যাই ভাষা শহীদের সম্মান জানাতে। তাদের অবদান বাঙালি জাতি কোনো দিন ভুলবে না।”

সাইক ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী রাদিয়া আক্তার মিম বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। তাই আমাদের উচিত নিজের মাতৃভাষা কে সম্মান করা।”

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী সজিব মোর্শেদ বলেন, “২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি একদিকে আবেগঘন অন্যদিকে আনন্দ ও উল্লাসের ও বটে কারন এইদিনে আমাদের মুখের ভাষা বাংলা আমাদেরকে দিয়েছে এক অনন্যতা, দিয়েছে এক অন্য সীমানা।
সকালে উঠে খালিপায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া স্মরণ করা বাঙালীর সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের এই ভাষা। আসলে এইদিনের তাৎপর্যতা কি শুধুমাত্র বছরের এই একটি দিনেই? প্রশ্নটিকি খুব বেশি অবান্তর? আমি এমনটি পোষণ করি না, এ দিনের তাৎপর্যতা এ দিনের গৌরব, মহানতা আসলে সবগুলো দিনেই আমাদের পোষণ করা উচিত। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের উচিত বাংলা ভাষা ভালোভাবে জানা, এর ব্যবহার ও সঠিক প্রয়োগে আগ্রহী হওয়া, পাশ্চাত্য ভাষার প্রতি ঝোক কমিয়ে এ ভাষার সঠিক প্রয়োগে আমাদের সকলকেই সচেতন হওয়া উচিত, বাংলা আমাদের গর্ব,আমাদের অনন্যতা আমাদের অহংকার, তাই এর মর্যাদা ও সঠিক পরিচর্যা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের সকলের উচিত এ ভাষার জন্য এগিয়ে আসার তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এর পথে এগিয়ে আসার। সর্বোপরি এই আত্মত্যাগ বাঙালির অহংকার, বাংলাদেশের অহংকার, ভাষা-শহীদদের এই ত্যাগের কথা এ জাতি কখনো ভুলবো না।”
২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নাম এবং এই জাতির ভাষার উপর প্রবল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবং বাঙালির আত্মত্যাগের চিত্র ফুটে উঠেছে। মাতৃভাষার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া, পৃথিবীতে বোধহয় এমন দৃষ্টান্ত আর নেই আর কখনো হবেও না। তাই তো নিজের অজান্তেই মনে বেজে উঠে ‘মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি বাংলা ভাষা’।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here