ডেস্ক রিপোর্ট::  বরিশাল নগরীর কলেজ অ্যাভিনিউ এলাকার বাসিন্দা ভ্যানচালক জাকির হোসেন। নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল সংলগ্ন মাছ বাজারে ঢুকেছেন এক কেজি ইলিশ কিনতে। ৪০টি দোকানের মধ্যে মাত্র তিনটি দোকানে মাঝারি সাইজের ইলিশ পেলেও দাম জেনে ইলিশ কেনার চিন্তা বাদ দেন তিনি।

তিনি বলেন, আজ এক কেজি জাটকা কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জাটকার দাম শুনে কেনার ইচ্ছা মরে গেছে। এখন বড় একটা পাঙাশ কিনেছি ৫৫০ টাকা দিয়ে।

মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুরে কথা হয় এই শ্রমিকের সঙ্গে। তার কেনা মাছ ভ্যানে করে নিয়ে যেতে যেতে বলেন, নদীর মাছ খাওয়ার ভাগ্য আমাগো নাই।

শুধু নথুল্লাবাদে নয় এমন চিত্র বড় বড় মৎস্য আড়ৎগুলোতেও। বরিশালের সবচেয়ে বড় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পোর্ট রোড, পটুয়াখালীর আলীপুর, বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাগরে জেলেরা গিয়ে শূন্য হাতে ফিরছেন। বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে ইলিশে সয়লাব থাকতো দক্ষিণাঞ্চলের বাজার। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। বৈশাখের শেষ পর্যায়ে এসেও ইলিশের দেখা মিলছে না। অথচ সারা দেশে মোট ইলিশের ৬৬ শতাংশ আহরিত হয় বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার নদ-নদী থেকে।

ইলিশ না থাকায় হাতেগোনা যে পরিমান ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তার দামও নাগালের বাইরে। যে কারণে ইলিশের বিকল্প হিসেবে তেলাপিয়া-পাঙাশ মাছ কিনছেন ক্রেতারা।

ইলিশ না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহকে শনাক্ত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। ভারী বর্ষণ ছাড়া শিগগিরই ইলিশ উঠবে না পাতে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

নথুল্লাবাদের মৎস্য আড়তদার জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, বৈশাখের শুরু থেকে ইলিশ আসার কথা। কিন্তু এই বছর ইলিশ আমরাই পাচ্ছি না। ইলিশ কম থাকায় দামও বেশি। তবুও করার কিছু নেই। আমরাই বেশি দাম দিয়ে কিনছি।

তিনি বলেন, জাটকা ৯০০ টাকা কেজি, পাঁচশ গ্রাম সাইজের ইলিশের কেজি দেড় হাজার টাকা, আর এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করছি।

আরেক ব্যবসায়ী কালাম হোসেন বলেন, নদীতেই মাছ নেই, বাজারে আসবে কোথা থেকে। এজন্য ইলিশের ব্যবসা আপাতত বন্ধ রেখেছি। এখন তেলাপিয়া, পাঙাশ বিক্রি করতেছি। ইলিশ না আসা পর্যন্ত আসলে ব্যবসা জমজমাট হবে না।

পোর্ট রোডের পদ্মা ইলিশ ঘরের আড়তদার অভি খান বলেন, জেলেরা খালি হাতে ফিরছে। নদীতে ১০/১৫ দিন থেকেও এক-দেড় লাখ টাকার ইলিশ পাচ্ছেন না। ইলিশের খুবই আকাল যাচ্ছে। তাছাড়া যে ইলিশ পাচ্ছি তা কিনতে আমারই কষ্ট হচ্ছে। জাটকা যদি ৯০০ টাকা কেজি হয় তাহলে মানুষ কেমনে খাবে।

সজিব হোসেন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, চৈত্র, বৈশাখ জৈষ্ঠ্য এ ৩ মাস ইলিশ কম থাকে। তবে এবার যেকোনো বছরের তুলনায় আরও কম ইলিশ। ভারী বর্ষণ ছাড়া জেলেদের জালেও ইলিশ ধরা পড়বে না। মানুষ যারা ইলিশ কিনতে আসেন দাম শুনে তেলাপিয়া-পাঙাশসহ দেশী যে মাছ আছে তা কিনে নিয়ে যায়। মানুষের করার কিছু নেই।

মৎস শিকারের ট্রলার মালিক বাজার রোডের বাসিন্দা বাপ্পী বলেন, সাগরে ইলিশ শিকারে গিয়ে এখন আর কোনো লাভ নেই। আগে সাগরে পর্যাপ্ত পরিমানে মাছ ছিল। জেলেদের নিয়ে এক একটি ট্রলার প্রস্তুত করে সাগরে পাঠাতে কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। ১০/১২ দিন পরে ট্রলারগুলো ফিরে আসে সর্বোচ্চ এক দেড় লাখ টাকার মাছ নিয়ে।

তিনি আরও বলেন, সরকার চেষ্টা করছে বিভিন্ন উপায়ে ইলিশ বৃদ্ধির। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। সরকারি নির্দেশে আমরা যখন সাগরে ট্রলার পাঠানো বন্ধ রাখি তখন ভারতের ট্রলার এসে আমাদের জলসীমায় ঢুকে মাছ শিকার করে।

বাপ্পী বলেন, অবরোধ উঠে যাওয়ার পর দুটি আমাবশ্যা-পূর্ণিমা পেয়েছি। দুটিতেই আমার ট্রলার সাগরে ছিল। কিন্তু খরচের টাকাও ওঠেনি।

সাগরের জেলে নূর মোহাম্মদ বলেন, এই মৌসুমটা খুবই খারাপ যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যতগুলো ট্রিপ সাগরে দিয়েছি তাতে খালি হাতেই আসতে হয়েছে। ঝড়-বন্যা যতদিনে না আসবে ততদিনে ওপরে ইলিশ উঠবে না।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, ইলিশ না পাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে এবারের দাবদাহ। ইলিশ সাধারণত শীতল পানিতে উজানে চলে। এ বছর দাবদাহে পানির উপরিতল শীতল নয়। তাছাড়া ডুবোচর, অনাবৃষ্টি আর পানি দূষণতো আছেই। নদী ও সাগরে প্রচুর ইলিশ থাকলেও দাবদাহ না কমায় ইলিশ উঠতে পারছে না।

তিনি আরও বলেন, ঋতুচক্রে বর্ষাকাল আগস্ট পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বৈশাখে দাবদাহের কারণে ইলিশ না পাওয়া গেলেও বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলিশও বাড়বে। কয়েকদিন আগে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শেষ হয়েছে। সে সময়ে মেঘনা, কীর্তনখোলাসহ আমাদের অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা লাফাতে দেখেছি। চলতি মৌসুমে দেশে ৬ লাখ টন ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here