উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অধিকাংশ ফসলী মাঠের কৃষকদের হতাশার সুর একই । অনাবৃষ্টির কারনে সৃষ্ট খরা, চাবাগান এলাকা থেকে প্রবাহিত ছড়া বন্ধ করে দেয়া এবং বিকল্প সেচ ব্যাবস্থা না থাকায় শ্রীঙ্গলের সর্বত্র বিপর্যস্থ কৃষকদের মাঝে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে সহায় সম্বল খুইয়ে এমনকি ধার-দেনা করে জমি চাষ করেছেন কৃষকরা। অপরদিকে বর্গাচাষ করে নিরূপায় হয়ে জমির মালিকদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন পরিত্রাণ পাওয়ার আশায়। ত্রিশংকু অবস্থায় সীমাহীন বিপাকে পড়েছেন শ্রীমঙ্গলের কৃষককূল। এক ফসলী জমিতে মোটামুটি ফলন হলেও দুফসলী জমিতে একেবারেই ফলন হয়নি বললেই চলে।

শ্রীমঙ্গলে এবার আমন উৎপাদন করে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছন কৃষকরা। প্রয়োজনীয় পানির অভাবে কাঙ্খিত উৎপাদন না হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষককূল। এবছর আমন ধান রোপনের পর পরই খরার কবলে পড়ে শ্রীমঙ্গলের বিসতৃর্ণ এলাকার ফসলী জমি। এমনকি ফসল তোলার এই সময়ে পানির দেখা না পেয়ে বজ্রাঘাতে যেন ধরাশায়ী হয়ে পড়েছেন চাষীরা। সময় পেরিয়ে গেলেও পানির অভাবে গোছায় ধান আসাতো দূরের কথা অনেক ফুলই আসেনি। এর ফলে সবকিছু হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

উপজেলার সদর ইউনিয়ন, ভূনবীর ইউনিয়ন ও মির্জাপুর ইউনিয়নে গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পানির অভাবে ফসলের মাঠ চৌচির হয়ে ধানের গোছা শুকিয়ে গেছে। কৃষকদের ভাষায় যাকে বলে পুড়ে গেছে। কোন কোন মাঠে ফসলের ফুল বের হয়ে চিটা হয়ে গেছে। আবার কোন কোন জমিতে ঘাসের ন্যায় ধানের গোছা দাঁড়িয়ে যেন কৃষকদের পরিহাস করছে। ধান কাটার ভরা মৌসুমেও দিনভর বিসতৃর্ণ এলাকার ফসলী মাঠ ঘুরে আলাপ করার জন্য কৃষকদের পাওয়া যায়নি। কৃষকদের বাড়ী বাড়ী ঘুরে এবং এলাকার বিভিন্ন বাজারে খুঁজে বের করে তাদের দু:খের কাহিনী শুনে রীতিমত হোচট খেতে হয়। উপজেলার অধিকাংশ কৃষকরাই তাদের ফসলের আশা  ছেড়ে দিয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন।

ভূনবীর ইউনিয়নের আলিশারকূল গ্রামের মো. বদরুল ইসলামের ১৫ কেদার, আব্দুল্লার ৫ কেদার (বর্গা), আব্দুর রউফের ৩ কেদার, গোপাল সরকারের ৩ কেদার, লৈয়ারকুলের খলিল মিয়ার ৭ কেদার, নিয়াজ ইকবালের ৯ কেদার, জালাল মিয়ার ৭ কেদার, আব্দুল হাসিমের ৫ কেদার বর্গাসহ ৭ কেদার, রাজপাড়ার আব্দুল কাদিরের ৫ কেদার, আকরম আলীর ৩ কেদার বর্গাসহ ৬ কেদার, শুকুর মিয়ার ১৩ কেদার, ৩ কেদার বর্গাসহ ৬ কেদার, সুলতান আহমদের ৪ কেদার বর্গাসহ ৮ কেদার, খলিল মিয়ার বর্গা ৫ কেদার। সবার বক্তব্য প্রায় একই, পানির অভাবে কেদার প্রতি ১ থেকে ৩ মণের উপর কোন জমি থেকেই ধান পাওয়া যাবেনা। এসব জমিতে গত মৌসুমে সর্বনিম্ন কেদার প্রতি ১৫/১৬ মণ ধান গোলায় তুলেছেন বলে কৃষকরা জানান।

খেত (ক্ষতে) কাঁচি  লইয়া (নিয়ে) যাওয়া লাগত (লাগবে) নায় (না), ধান গরুয়ে খাইবনে (খাবে)। ১৬ মন দূরের কথা ১৬ সেরও পাইতাম (পাব) নায় (না)। আমন উৎপাদনে বিপর্যয়ের কারনে ফসল হারিয়ে এমনই প্রলাপ বকছেন শ্রীমঙ্গল ভূনবীর ইউনিয়নের লৈয়ার কুল গ্রামের কৃষক খলিল মিয়া।

ভূনবীর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নিয়াজ ইকবাল মাসুক জানান, এলাকার কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে গরীব ও ভূমিহীন কৃষকরা ধার দেনা করে বীজ, হালি ও কীটনাশক সংগ্রহ করে এবং নিজের অর্থসম্বল ঢেলে দিয়ে এখন অকুল সাগরে ভাসছেন। বৃষ্টি নির্ভর ফসলী মাঠে এ মৌসুমে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ফসল হারিয়ে অকুল সাগরে ভাসছেন তারা।

শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের নোয়াগাও এলাকার কৃষক ইউছুফ মিয়া ভারাক্রানত্ম মন নিয়ে বলেন, মেঘ নেই, সেচের কোন ব্যবস্থাও নেই। বর্গাসহ ৬০ কেদার জমিতে গত বৎসর যেখানে প্রায় ৭০০ মন ধান তুলেছেন এবার এই পরিমান জায়গা থেকে ১০০ মনও পাবেন না বলে জানান তিনি।

উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো.ফিরোজ মিয়া জানান, এক ফসলা জমির ৬০ জমিতে ধান ভাল হয়েছে তবে ৪০ ভাগ জমির ধান বিনষ্ট হযে গেছে। এদিকে দূফসলা জমির উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ৫০ ভাগ জমিতে কৃষকরা ধানই পাবেনা। অনাবৃষ্টির কারণে খরা কবলিত হয়ে কোথাও ধান আসে নাই, কোথাওবা চিটা হয়ে গেছে, আবার কোথাও খরায় ফসল পুড়ে গেছে।

মাঠের এই দূরাবস্থার ব্যাপারে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অজিত পাল বলেন, কোন কোন জায়গায় পানির অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে কৃষকদের ঢালাও অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর যেখানে শ্রীমঙ্গলের গড় উৎপাদন ছিলহেক্টর প্রতি ৬ থেকে সাড়ে ৬ টন। পানির অভাবে এবার উৎপাদন নেমে হয়তো ৫ থেকে সাড়ে ৫ টনে দাঁড়াবে। উপজেলার ভূনবীর ইউনিয়ন কার্যালয়ে এই কর্মকর্তার সাথে আলাপকালীন উপস্থিত একই এলাকার কয়েকজন কৃষক তার এ বক্তব্যের বিরুধিতা করে তাৎক্ষনিক তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যে আশা নিয়ে এবার বুক বেধে ছিলেন পানির জন্য সে আশায় গোড়েবালি হয়েছে। অধিকাংশ কৃষকরাই তাদের ফসলের আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন বলে তারা জানান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দাশ বলেন, এবছর আমন ধান আবাদের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ১৪৭৩৫ হেক্টর জমি। আবাদ করা হয়েছে ১৪৮৭৫ হেক্টর। ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৪৩৯৩ মেট্রিক টন। এ পর্যনত্ম ধান কাটার (ক্রপ কার্টিং) ফলাফল বিশ্লেষনে দেখা গেছে, হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ ৫.০৩ এবং সর্বনিম্ন ১.৭৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। এতে লক্ষমাত্রা অর্জনে আমি আশাবাদী।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/কাওছার ইকবাল/শ্রীমঙ্গল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here