“ইতিহাস গবেষক রাজিব আহম্মেদ লিখছেন”
এবার বোধহয় আর স্মরণিকা প্রকাশ করা হলো না, জাহিদ বললো। কেউ কোনো কথা বললো না, কিন্তু সবাই যে মর্মাহত সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিলো। কথা হচ্ছিলো বিজয় দিবস উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশ নিয়ে। আমাদের একটা সাহিত্য সংগঠন আছে। প্রতি বছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে আমরা সেখান থেকে স্মরণিকা প্রকাশ করি। এবারো প্রকাশ করার কথা ছিল, কিন্তু হবে না।
স্মরণিকা প্রকাশের ব্যয়ভার বহনের জন্য আমরা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নিতাম। কিন্তু এবার কেউ দিতে চাচ্ছে না, মন্দা ব্যবসার অজুহাত দেখাচ্ছে। আর বিজ্ঞাপন না পেলে স্মরণিকা প্রকাশের টাকা কোথায়? সুতরাং এবার আর স্মরণিকা বেরুবে নাজ্জ এটাই ফাইনাল।
তাহলে পত্রিকায় লেখা আহ্বানের বিজ্ঞাপন ছাপানোর কী দরকার ছিল, আমার বাড়িতে তো লেখার পাহাড় জমে গেছে! ক্ষোভের সঙ্গে শাব্বীর বললো।
কে জানতো, এবার স্মরণিকা প্রকাশিত হবে না? তাই প্রতিবারের মতো ঠিকই লেখা আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। লেখা আসতেও শুরু করেছে আর এগুলো গুছিয়ে রাখছে শাব্বীর।
এমন সময় দরজার কাছে একজন বয়স্ক লোককে দেখলাম। লোকটি জিজ্ঞেস করলো, এখানে সুহৃদ সাহিত্য পরিষদ কোনটা? বললাম, এটাই তার কার্যালয়, কী দরকার বলুন? আমি একটা লেখা নিয়ে এসেছিলাম, আপনাদের স্মরণিকায় প্রাকশের জন্য।
পত্রিকায় লেখা আহ্বানের বিজ্ঞাপন দিলেই হরেকরকম লোক আসে। হরেকরকম লেখা আনেন তারাজ্জ ভাই ছাপতেই হবে, বহু কষ্টে লিখেছি ইত্যাদি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা! এ লোকটিকেও সে রকমই মনে হলো। তবু জিজ্ঞেস করলাম, আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা! ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলাম লোকটাকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একটা ময়লা লুঙ্গি, ছেঁড়া পাঞ্জাবি রয়েছে পরনে। লোকটি বললো, যুদ্ধের সময়েই অবসরে লিখেছি; কিন্তু এতদিন গোপন রেখেছিলাম। কারো কাছে যেতে ভরসা পাই না, তা বাবা তোমরা যদি এ লেখাটা ছেপে দাও তো কৃতার্থ হই।
নিশ্চয় নিশ্চয়, সোহেল বলল। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আপনার লেখাই তো আমরা ছাপতে চাই, কিন্তু…। কথা শেষ করার আগেই চুপ করার ইশারা করলাম সোহেলকে। একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে লেখা নিয়ে এসেছেন, তাকে নিরাশ করাটা ঠিক হবে না। আমরা স্মরণিকা বের না করলেও প্রকাশের ব্যবস্থা ঠিকই করতে পারবো। বললাম, আপনার লেখাটা দিন। লোকটি একটি মলিন খাতা এগিয়ে দিলো। উনি লেখার নাম দিয়েছেন ‘মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি’। আমি পাতা উল্টে পড়তে শুরু করলাম।
‘একটা উচু টিবি, দুটো তালগাছ, কলা বাগান, বাতাবি লেবুর গাছ, শিউলি ফুলের গন্ধ। সেই সকাল থেকে অস্ত্র হাতে বসে বসে পাহারা দিচ্ছি। এখনো খাইনি; রান্নার আয়োজন শেষ হয়নি। আজ কয়েকদিন হলো এখানে আছি। ক’দিন আগেও এটা ছিল একটা সুন্দর সাজানো গ্রাম। সবই ছিল, চাষীরা মাঠে চাষ করতো; কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত থাকতো। কিন্তু আজ কেউ নেই, সারাটা গ্রাম জুড়ে আমরা ১৭জন মাত্র। পাকিস্তানি সেনারা এসে সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। নির্যাতনের চিহ্ন, চারদিকে পোড়াবাড়ি; এর কয়টিতে আমরা আশ্রয় নিয়েছি। এর আগে ছিলাম মোমিনপুরে, কিন্তু এ গ্রামটির নাম জানি না; নাম জানানোর মতো একটি লোকও নেই গ্রামে, সবাই পালিয়েছে।
আমার পাশেই আরেকটা উঁচু ঢিবি। সেখানে একজন সহযোদ্ধা বসে আছে। এই মুহূর্তে ঐ তরুণ সহযোদ্ধাকে নিজের আপন ভাই ভাবতে ইচ্ছে করছে। রক্তের কোন সম্পর্ক নেই, তবু ঐ তরুণটিই আমার ভাই, কিন্তু একদিন যারা ছিল একই দেশের নাগরিক, আজ তাদের দেখলেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে। এই তো সেদিন, দশজনের একটা গ্রুপের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ হলো; একটাকেও জ্যান্ত ফেরত যেতে দিইনি। একটাকে মারতে পারলেই উল্লাসে ফেটে পড়ি; আর এক সঙ্গে দশটা। ঘৃণা জাগে মৃতদেহগুলো দেখে; আবার মায়াও লাগে। কী দরকার ছিল বাপু, বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী- ছেলেমেয়ে রেখে বারোশো মাইল দূরের আরেক দেশে এসে যুদ্ধ করবার?
দূরের গ্রামটিতে কী যেন নড়ে উঠলো; তারপর চুপ। শুনেছি ওখানেই নাকি পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই শান্ত; কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কী জানি, হয়ত ভুল দেখেছি। আজ দু-তিন রাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি, শুধু বাড়ির কথা মনে পড়েছে। জানি না, আব্বা-আম্মা আর শেলীরা এখন কোথায়? কোথাও পালিয়ে গেছে অথবা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে! দু-দিনের ছুটি নিয়ে গিয়ে দেখে দেখে এলে কেমন হয়? আমাদের কমান্ডার কাজলদা খুব ভালো মানুষ, ছুটি চাইলে না করবেন না হয়তো; আবার করতেও পারেন। উনার কাছে যুদ্ধই বড়; কার মা-বাপ কোথায় মরলো, তা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যাথা নেই।
ক’দিন আগে খবর এলো, আমাদের এক সহযোদ্ধার মা-বাবা আর ছোট্ট ভাইটি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে মারা গেছে। ঠিক সেই সময় বেতাই সীমান্তে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। কাজলদা অত্যন্ত কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেনজ্জ যুদ্ধ ফেলে মা-বাবা-ভাইয়ের লাশ দেখতে যাওয়ার অধিকার নেই কারো। লাশগুলো কবর দিয়ে ফেলতে বলুন। অবশ্য কাজলদা’র এই সিদ্ধান্ত খারাপ হয়নি। সেদিন আমরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম মাত্র ১৩ জন আর ওরা ছিল পঞ্চাশের মতো। এ অবস্থায় যুদ্ধ ফেলে একজন চলে গেলে বাকি সবাই মারা পড়তে পারতাম।
এই কাজলদাই আবার মাটির মানুষ হয়ে যেতেন। একদিন আমি আর সহযোদ্ধা রিচার্ড কাভারিং ফায়ার দিয়ে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছিলাম। সেদিন সত্যিই ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। ফিরে এসে সব বলার পর কাজলদা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কোনদিন খাবার কম পড়লে নিজে খেতেন না। প্রথম প্রথম আমরা জানতেও পারিনি। আফজাল একদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর জিজ্ঞেস করায় কাজলদা বলেছিলেন, তোরা পেট পুরে খেলেই আমরা শান্তি। কিন্তু আফসোস, এই কাজলদাকে বাঁচাতে পারলাম না!
একদিন সময়মতো রান্ন হয়নি বলে কাউকে কিছু না বলে নিরস্ত্র অবস্থায় পাশের একটা গ্রামে দিয়েছিলেন চিড়ে-মুড়ি যোগাড় করার জন্য। সেখানেই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পরে কাজলদাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। কাজলদা একটা কথা খুব বেশি করে বলতেন, এদেশ আমাদের, দেশের সম্মান সবচেয়ে বড় কথা। দেশের জন্য প্রাণ দিস, তবু মান দিবি না। নিজের জীবন দিয়ে এই সত্যটা তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেলেন।
আচ্ছা আমরা কিসের জন্য যুদ্ধ করছি? বাড়ি থেকে আসার সময় বলেছিলাম, মা দেশের জন্য যুদ্ধে যাচ্ছি। কী জানি, উত্তরাটা হয়তো সঠিক হয়নি। দু-দিন আগেই রেডিওতে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটা শুনলাম। তাই যদি হবে, তবে সেই ফুল কোনটাজ্জ স্বাধীনতা?
আসলে বাঁচার মতো বেঁচে থাকার জন্যই যুদ্ধ করছি আমরা। তবে স্বাধীকার কি আদৌ পাবো? ঐ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ আর শান্তি কমিটির লোকগুলো যদি বেঁচে থাকে, ওদের যদি বিচার না হয়, তবে যুদ্ধ করেই-বা লাভ কী?
যাকগে ওসব কথা। দেশ যদি স্বাধীন হয়, তবে ওদের বিচার কেউ ঠেকাতে পারবে না; কেউ ক্ষমা করতে পারবে না। এখন অতসব ভেবে লাভ নেই। এখন শুধু ভাববো, কিভাবে দেশটাকে তাড়াতাড়ি স্বাধীন করা যায়। দেশ যদি স্বাধীন হয়, ততদিন যদি বেঁচে থাকি, তবে গ্রামে ফিরে গিয়ে হয়তো অনেকেরই দেখা পাবো না। যাদেরকে পাবো, তাদের নিয়ে সুখী-সুন্দর সমাজ গড়ে তুলবো। নতুন যারা জন্মবে তাদের যুদ্ধের স্মৃতিকথা শোনাবো, ছোট থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলবো। তবে বেঁচে থাকবো কিনা জানি না, সেদিনই তো অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম। মাথার সামান্য ওপর দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেল।
মরে গেলেও মন্দ হয় না; দেশের মানুষ তো ঠিকই আমায় স্মরণ রাখবে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা- এটাই আমার বড় পরিচয়। বাঁচালেও গর্ব কম হবে না, আমি হবো স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক; ফিরে পাবো আমার স্বাধীকার। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার চেয়ে বেশি গর্ব আর কিসেই-বা হতে পারে? তাছাড়া আমার পরিচয় আমি দেশের জন্য অস্ত্র ধরেছিজ্জ জীবনবাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধা!
মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক বলাকা উড়ে গেল। ইস্ এই বলাকাগুলো যদি উড়োজাহাজ হতো! তবে আমরাও দেখে নিতাম, পাকিস্তানি উড়োজাহাগুলো কিভাবে এ দেশের মাটিতে বোমা ফেলে।
আবার সামনে তাকাই। দু’টো তালগাছ, কলাবাগান, বাতাবি লেবুর গাছ, শিউলি ফুলের গন্ধ। দুরে একটা সবুজ ধানক্ষেত। তার মধ্যে কার যেন একটা লাল চাদর পড়ে আছে। চোকের সামনে সবুজ জমিনে লাল বৃত্ত খচিত পতাকা ভেসে উঠে!’
খাতাটি বন্ধ করে লোকটির দিকে তাকালাম। উত্তোজনায় ঠিকমতো কথা বলতে পারলাম না। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, আ-আ-প-নি লিখেছেন?
হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালেন তিনি। আরো জনালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা আরেকটা খাতা হারিয়ে গেছে।
আমি খাতাটি জহিদের হাতে দিয়ে পড়তে বলে লোকটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, লোকটি একজন জীবনবাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালে কতই না প্রতাশা ছিল তাঁর, কিন্তু সেগুলো কি আদৌ পূরণ হয়েছে? তাঁর প্রত্যাশা ছিল একটা স্বাধীন সুন্দর দেশ- যেখানে কোন স্বাধীনতা বিরোধী থাকবে না, থাকবে শুধু মুক্তিযোদ্ধা আর তার পরবর্তী প্রজন্ম। অথচ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস আজো বাংলার বুকে উন্মুক্ত নৃত্য করছে; তারা আবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে! আমরা তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারিনি। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন মূল্যায়ন হয় না। কারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নামও আমরা ঠিকমতো জানি না। হায় দেশ!
ততক্ষণে জাহিদ-শাব্বীররা লেখাটি পড়ে ফেলেছে। উত্তেজনায় ওরাও কথা বলতে পারছে না। শাব্বীর বললো, আমরা স্মরণিকা প্রকাশ করবোই। জাহিদ, মাসুদ, মুকুল, আদিল, মাবুদ সবাই একমত পোষণ করলো। তারপর চুড়ান্ত সম্মতির জন্য আমার দিকে তাকালো। আমি স্মরণিকার সম্পাদক; সুতরাং আমার মতামতটা জানা জরুরি। আমি তখনো উত্তেজনা কাটাতে পারিনি। অস্পষ্ট স্বরে বললাম, হ্যাঁ স্মরণিকা প্রকাশ করবোই।