আসামের রাজধানী গৌহাটি থেকে স্থানীয় সাংবাদিক হায়দার হুসেন বিবিসি বাংলাকে জানান, সোমবার দুপুরে মুম্বাই থেকে ভূপেন হাজারিকার মৃতদেহ পৌঁছুনোর পর থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নেমেছে৻

জজ হিল নামে গৌহাটির যে জায়গায় তাঁর মৃতদেহ রাখা রয়েছে, সেখানে সর্বক্ষণ মানুষের দীর্ঘ লাইন রয়েছে৻

 “মানুষের লাইন কখনো কখনো দুই-আড়াই কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে৻ প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ থেকেও মানুষজন তাঁকে শেষবারের মত একনজর দেখার জন্য গৌহাটিতে ভিড় করছে৻ কোন একজন মানুষকে নিয়ে এ‌ ধরনের আবেগ আসামে এর আগে চোখে পড়েনি৻“

তিনি বলেন, শেষ জীবনে ভূপেন হাজারিকার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মুত্যুর পর আসামের মানুষ সে বিতর্ক মনে রাখেনি৻

মানুষের ভিড়ের কথা বিবেচনা করে আসামের রাজ্য সরকার ভূপেন হাজারিকার শেষকৃত্য একদিন পিছিয়ে বুধবার ধার্য্য করেছে৻

 গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের কাছে একটি মাঠে তাঁকে দাহ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে৻

মুখাগ্নি করার জন্য প্রয়াত ভূপেন হাজারিকার ছেলে তেজ হাজারিকা নিউইয়র্ক থেকে মঙ্গলবার গৌহাটি পৌঁছেছেন৻

কোলকাতা থেকে অমিতাভ ভট্টশালি জানিয়েছেন, শেষকৃত্যে যোগ দিতে ভারদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার একজন প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন৻ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও একজন প্রতিনিধি গৌহাটি যাচ্ছেন বলে জানা গেছে৻

ভূপেন হাজারিকার দেহ ভস্ম আসামের প্রতিটি জেলায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে রাজ্য সরকারের সূত্র উদ্ধৃত করে সাংবাদিক হায়দার হোসেন জানিয়েছেন৻

ব্রহ্মপুত্রের চারণকবি বলে খ্যাত ভূপেন হাজারিকা ৮৬ বছর বয়সে মারা যান শনিবার৻ তিনি কিডনির রোগে ভুগছিলেন৻

কিংবদন্তি হয়ে ওঠা

উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে ১৯২৬ সালে এক শিক্ষক পরিবারে জন্ম ভূপেন হাজারিকার৻ গুয়াহাটি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় আর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন৻ আমেরিকায় থাকার সময়েই তাঁর পরিচয় কিংবদন্তী শিল্পী পল রবসনের সঙ্গে, যাঁর অনেক বিশ্ববিখ্যাত গানের ভারতীয় রূপান্তার করেছেন ভূপেন হাজারিকা৻

কিন্তু তার অনেক আগেই, ১৯৩৯ সালে অহমীয়া ভাষায় প্রযোজিত দ্বিতীয় ছায়াছবি ইন্দ্রমালতীর জন্য গান গেয়ে তাঁর সঙ্গীত জীবনের শুরু৻ তখন মি. হাজারিকার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর৻

অহমীয়া লোক সঙ্গীতের আধারে একের পর এক গান লিখেছেন, সুর করেছেন৻ যুক্ত হয়েছেন বামপন্থী গণনাট্য আন্দোলনে – যার ফলে ভূপেন হাজারিকার গানে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়ে এসেছে৻ প্রথমে অহমীয়া ভাষায় গাওয়া তাঁর গানগুলিতে, আর তারপরে যখন তিনি কলকাতায় এলেন, তখন তাঁর বাংলা গানগুলিতেও – যেমন, ‘মানুষ মানুষের জন্য৻’

আসামে যতটা জনপ্রিয় মি. হাজারিকা, ততটাই তাঁর গানকে ভালবাসতেন বাংলাভাষীরাও৻ তাই বাংলাকে একের পর এক অসাধারন গান উপহার দিয়ে গেছেন তিনি, যার মধ্যে জনপ্রিয়গুলোর একটা – ‘আমি এক যাযাবর।’

যাযাবর ছিলেন বলেই আসাম থেকে কলকাতা, সেখান থেকে মুম্বাই পৌঁছেছিলেন ভূপেন হাজারিকা — সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতে৻ আর হিন্দীতেও গেয়েছেন অসংখ্য গান। হিন্দী গানের মধ্যে সাম্প্রতিক কালের বিখ্যাত রুদালি ছবির ‘দিল হুম হুম করে’ গানটা৻ এই গানটা নিয়ে মি. হাজারিকা মন্তব্য করেছিলেন, ঐ সুরটা অনেকটা তাঁর মায়ের গলায় শোনা একটা ছেলেভোলানো গানের সুরের মতো৻

রুদালি ছবির পরিচালিকা কল্পনা লজমির সঙ্গে তার অনেক আগে থেকেই অবশ্য বসবাস শুরু করেছিলেন তিনি৻ গানের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছায়াছবি প্রযোজনা আর পরিচালনাও করেছেন – অহমীয়া আর বাংলায়৻ গান লেখা, সুর করা, ছায়াছবি পরিচালনা করা – এসবের জন্য ভূপেন হাজারিকা পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। যার মধ্যে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের সম্মান যেমন আছে, তেমনই আছে পদ্মশ্রী, দাদাসাহেব ফালকে সম্মান আর সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার।

সারা জীবন মি. হাজারিকা বামপন্থীদের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত হয়ে এলেও ২০০৪ সালে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি তাঁকে লোকসভা ভোটে দাঁড় করায়৻ ঐ নির্বাচনে তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।

সূত্র : বিবিসি

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/আন্তর্জাতিক ডেস্ক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here