হোসেইন জামাল :: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষটা খুব কষ্টে কেটেছে। তবে কষ্টটা আরো বাড়তো, যদি রাকিব ভাই না থাকতেন। খুবই মিশুক প্রকৃতির মানুষ রাকিব ভাই। ক্যাম্পাসের জুনিয়র কী সিনিয়র সবার কাছেই উনি শ্রদ্ধার, স্নেহের। সহজেই যে কাউকে কাছে টেনে নেয়ার বিশুদ্ধ ক্ষমতা আছে উনার। তাই বিষয়টা উনার সাথে শেয়ার করলাম।
এসএসসির পর গ্রামে টিউশন শুরু করি। ছাত্ররা বেশিরভাগ ছিল আমার স্কুলের দুই-তিন ব্যাচ জুনিয়র ছোট ভাই। এদেরকে পড়িয়ে গণিত আর ইংরেজি ভিত্তিটা আরো শক্ত পোক্ত করেছি। গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রায় অসহায় হয়ে পড়লাম।
ওই সময় রাকিব ভাই এসে আমার অসহায়ত্ব দূর করলেন। শহরের হামজারবাগের একটা কোচিংয়ে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। অরবিট কোচিং সেন্টার। নাইন টেনের ইংরেজির ক্লাস নিতে হবে। ক্লাস প্রতি ২৫ টাকা। দৈনিক দুটি ক্লাস।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে অরবিটের মতো এমন হাজার হাজার কোচিং সেন্টার গজিয়েছে। আর মানুষের রোগ-ব্যাধিকে পুঁজি করে গজিয়েছে হাজারো হাসপাতাল, ক্লিনিক। যাদের স্থায়ী কোন ডাক্তার রাখার মুরোদ নেই।
আমার অসহায়ত্ব পুঁজি করে যেমন অরবিট কোচিং টাকা কামিয়েছে, তেমনি এদেশের শিক্ষানবিশ ডাক্তারদের অসহায়ত্ব পুঁজি করে গঁজিয়ে ওঠা হাসপাতালগুলো টাকা কামাচ্ছে। কতিপয় নাম কামানো ডাক্তারদের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে এরা টেস্ট বাণিজ্য তথা টেস্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমেও মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তবে এবার করোনা এসে তাতে বাঁধ সেধেছে। এখন ডাক্তাররা নিজেদের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। টেস্ট সন্ত্রাস স্থগিত, স্থবির। অল্প টাকার কামলা অসহায় শিক্ষানবিশগুলোও বাসা থেকে বের হতে পারছে না। যা ফলাফল হলো পত্রিকায় দেখি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
এদেশে এতদিন বেসরকারি বানিজ্যিক চিকিৎসা ব্যবস্থা দেদারছে চলমান ছিল। রোগী নিয়ে টানা টানির হিড়িক পড়ে যেত। এখন স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য বানিজ্যক কার্যক্রম। এদেশের অসহায় রোগীরা ছিলেন এদের সন্ত্রাসের শিকার। করোনা এসে সেটা কমিয়েছে মাত্র।
এখনো দুই একটি বড়লোকের হাসপাতাল ছাড়া পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকার নির্ভর। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সরকারি চিকিৎসা হচ্ছে একমাত্র অবলম্বন। তাহলে প্রশ্ন আসে, এদেশে এতোদিন চিকিৎসার নামে কি হয়েছিল, আর সরকার কি করেছিল ?
আসলে এদেশে এতোদিন চিকিৎসার নামে সাধারণ মানুষের টাকা ছিনতাই হয়েছে। আর সরকার বাহাদুরের কতিপয় আমলাসহ অন্যান্যরা ছিনতাইয়ের অর্থের ভাগ পেতেন। এভাবেই একটা চেইনে সবকিছু চলছিল। তবে করোনা এসে সেই চেইন সিস্টেমটি ভেঙে দিয়েছে।
কারণ গঁজিয়ে ওঠা হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে করোনা রোগী চিকিৎসার করার সুযোগ নাই। এর মধ্যে টেস্ট সন্ত্রাসও চালানো সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে হয়তো অচিরেই বেশকিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাবে।
করোনা পরবর্তী যে ক্ষতি সেটা পুষিয়ে ব্যবসা করা কঠিন হবে। এছাড়া এরই মধ্যে মানুষ বুঝতে পেরেছে, করোনার সময় এসব হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক থেকে তারা সেবা বঞ্চিত হয়েছে। ফলে দ্বিতীয়বার তারা ওইমুখী হবে না।
এখন এই চিকিৎসা সন্ত্রাস রোধে সরকারের বিশেষ ভূমিকা অপরিহার্য। যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক বাধ্য হয়ে বন্ধ হবে, সেগুলো তো গেলোই। বাকিগুলো করোনার দুর্যোগে কি ভূমিকা রেখেছে, তা মূল্যায়ন করতে হবে। এসব চিকিৎসা সন্ত্রাসীদের টুটি চেপে ধরার এখন সময়।
পাশাপাশি সরকারকে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা সরকারকে যে বাধ্যতামূলক সেবা দেয়, ওই সময়ে তাদের পরিবার চালানো মতো উপযুক্ত অর্থ প্রদান করতে হবে।
কারণ একটা সন্তানকে ডাক্তার বানাতে গিয়ে একটা পরিবার প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সন্তানটি যখন ডাক্তার হয়, তখন পরিবারের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। সেই প্রত্যাশার চাপে বাধ্য হয়ে ছোটখাটো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সস্তায় শ্রম বিক্রি করে।
দ্বিতীয়ত, যুগের পর যুগ চলে আসা দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসা সেবায় গণমানুষের আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে হবে। কারণ পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসাও একটি। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তার নাগরিকদের চাহিদার এই দায়ভার কখনো এড়াতে পারে না।তাই সরকারি হাসপাতালে সেবার কাঠামো পরিবৃদ্ধি করতে হবে।
লেখকঃ ব্যাংকার ও মুক্ত গণমাধ্যমকর্মী