আজ ‘‘বিষাদ সিন্ধু’’ রচয়িতা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের ১৬৪তম জন্ম বার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালী লাহিনীপাড়ায় অবস্থিত মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠান এবং ৭ দিনের মীর মেলার আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসুচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃতি, নাটক এবং মীর মেলা। আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফ। বিশেষ অতিথি থাকবেন জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক, পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ডঃ মহিউদ্দিন, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আসগর আলী, কুমারখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শিক্ষানূরাগী আব্দুর রউফ। আলোচনায় অংশ নেবেন গিয়াস উদ্দিন ও ম.মনিরুজ্জামান। উদ্বোধনী দিনে কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমীর শিল্পীগণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। পরে মীর মশাররফ রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ নাটক মঞ্চস্থ হবে। এছাড়া ৭ দিন ব্যাপী মীরের বাস্তভিটায় মীর মেলার আয়োজন করা হয়েছে। কাল দ্বিতীয় দিনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সুলতানা তরুণ। সভাপতিত্ব করবেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ডঃ মহিউদ্দিন। বিশেষ অতিথি থাকবেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ডঃ মল্লিক আনোয়ার হোসেন, তাইজাল আলী খান, শিল্পকলা একাডেমীর সাধারন সম্পাদক আমিরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেবেন কুমারখালী ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক নাদের হোসেন, পোড়াদহ ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোশারফ হোসেন। আলোচনা শেষে  কুমারখালীর শিল্পীদের পরিবেশনায় সংগীত অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে আজ বিকেল ৪টায় কুষ্টিয়া পৌরসভা মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন পৌর মেয়র আনোয়ার আলী। আলোচনায় অংশ নেবেন বিশিষ্ট গবেষক ও ইবি বাংলা বিভাগের প্রফেসর ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী। উল্ল্লেখ্য, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কুমারখালীর  লাহিনীপাড়া গ্রামে । লাহিনীপাড়ায় তাঁর ঘর বাড়ির আর কোন অস্তিত্ব নেই। তবে মীরের নিজ হাতে লাগানো একটি মৃত আম গাছ তাঁর স্মৃতি ও কালের নীরব সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মীরের জন্মের পর তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে লাহিনীপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন এলাকার সম্‌ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম দৌলতুন্নেসা। মীর মশাররফ প্রথমে জগনমোহন নন্দীর পাঠশালায় পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি কুমারখালির এমএন হাই স্কুল, কুষ্টিয়া হাই স্কুল ও রাজবাড়ি জেলার পদমদী হাই স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। ১৮৬০ সালে  মীর মশাররফের মা দৌলতুন্নেসা মারা যান। সেই সময় মীরের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। এ বয়সেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ ও ধর্ম বিষয়ক প্রায় ৩৫টি বই রচনা করে গেছেন। এরমধ্যে রত্নাবতী, গৌরী সেতু, বসন্তকুমারী, নাটক জমিদার দর্পণ, সঙ্গীত লহরী, উদাসীন পথিকের মনের কথা,মদীনার গৌরব,বিষাদসিন্ধু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন। প্রথমে তিনি কাঙাল হরিণাথ মজুমদারের সাপ্তাহিক গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ও কবি ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন। এরপর ১৮৮০ সালে তিনি লাহিনীপাড়া ‘হিতকরী’ নামের একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। মীর মশাররফ হোসেন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় কলকাতায় তাঁর বাবার বন্ধু নাদির হোসেনের বাড়িতে থেকে কিছু দিন পড়াশুনা করেন। এখানে থাকাকালে নাদির হোসেনের বড় মেয়ে লতিফুন নেছার সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং পরে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু নাদির হোসেন বিয়ের সময় বড় মেয়ের পরিবর্তে মেজ মেয়ে আজিজন নেছার সাথে মীরের বিয়ে দেন। এঘটনার পর লতিফুন নেছা আত্নহত্যা করেন। প্রথম বিয়ে সুখের না হওয়ায় মীর মশাররফ ৮ বছর পর কুমারখালীর সাঁওতা গ্রামের বিধবা কুলসুম বিবির সাথে দ্বিতীয় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে প্রথম স্ত্রীর সাথে তাঁর মনোমালিন্য আরো তীব্র হয়। এরপর তিনি স্ত্রী কুলসুম বিবিকে নিয়ে লাহিনীপাড়া ছেড়ে টাঙ্গাইলে চলে যান এবং সেখানে বসবাস করতে থাকেন। প্রথম স্ত্রী আজিজন নেছা কয়েক বছর নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করার পর লাহিনীপাড়ায় মারা যান এবং এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। মীরের প্রথম স্ত্রীর কোন সন্তান ছিল না। তাঁর ৫ ছেলে ও ৬ মেয়ের সকলেই দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুম বিবির গর্ভজাত। ১৯১১ সালে মীর মশাররফ ও তার স্ত্রী রাজবাড়ি জেলার পদমদী গ্রামে আসার পথে পাংশায় এলাকায় কুলসুম বিবি মারা যান। একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দী উপজেলার পদমদী গ্রামে ৬৪ বছর বয়সে মীর মশাররফ হোসেন মারা যান এবং সেখানেই স্ত্রী কুলসুম বিবির কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ মীর মশাররফ হোসেনের অমর কীর্তি ও জন্মের পর তাঁর শৈশব-কৈশর যে লাহিনীপাড়া গ্রামের মাটিতে কেটেছে সেই গ্রামের বসতবাড়ির ভিটা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থাকার পর গত বছর স্থানীয় জেলা পরিষদের উদ্যোগে ‘মীর মশাররফ হোসেন লাইব্রেরী কাম অডিটোরিয়াম’’ নির্মান করে। এলাকার মানুষ মীরের নামে একটি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সর্বত্মরের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে মীরের বাস্‌ত্তভিটার কয়েক গজ পূর্বে গড়াই নদীর ওপর ব্রীজের নাম সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন সেতু নামকরণ করা হয়। যদিও বিগত ২০০৫ সালে কুমারখালি-খোকসা তথা সমগ্র কুষ্টিয়াবাসির প্রাণের দাবি ছিলো মীরের নামে নামকরণের। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সেসময় ব্যপক আন্দোলনও হয়। সে সময়ের সরকার এ এলাকার গণ মানুষের দাবি উপেক্ষা করে এ আসনের বিএনপির এমপির বাবার নামে নামে সেতুটির নামকরণ করেন।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/কাঞ্চন কুমার/কুষ্টিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here