ফাতিহুল কাদির সম্রাট
ফাতিহুল কাদির সম্রাট

ফাতিহুল কাদির সম্রাট :: করোনাকালে আমার একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে, ইসলামি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়টা জরুরি। যাঁরা আধুনিক শিক্ষা বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁরা ধর্মীয় জ্ঞান বলতে কেবল ইবাদাতের নিয়মকানুনকেই বুঝেন। কুরআনিক জ্ঞানকে তাঁরা সজ্ঞানে এড়িয়ে যান। আর আলেমগণ ধর্মীয় ইলমকে নিজেদের খাসভূমি করে নিয়েছেন, বিজ্ঞানের নামে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয় তাঁদের। ফলে জ্ঞানগত দিক দিয়ে দুই ভূবনের বাসিন্দা হয়ে আছেন তাঁরা। তাঁরা কেউ কাউকে চেনেন না,চিনতে চেষ্টাও করেন না। এই দুইয়ের দূরত্ব সাধারণ মানুষের জন্যে বিপদ ডেকে আনছে। তাদের একজনের যেমন নেই বিজ্ঞান সম্পর্কিত স্পষ্ট জ্ঞান, তেমনি আরেকজনের নেই ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা। ফলে বিভ্রান্তির বেড়াজালে তাঁরা উভয়েই আটকা পড়ে আছেন।

পবিত্র কুরআন ও হাদিসে ইলম (জ্ঞান)-এর মাহাত্ম্য অনেক। ইলম চর্চার জোর তাগিদও আছে ইসলামে। বস্তুত ইলম আহরণ করা সবার ওপর ফরজ। কিন্তু এই ইলম-এর স্বরূপ কী সেটা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা অস্পষ্ট। যাঁর ইলম আছে তিনি আলেম। আমাদের দেশে আলেম বলতে যাঁদের বুঝি তাঁদের দিকে তাকালেই ইলম সম্পর্কিত আমাদের ধারণাটি স্পষ্ট হয়। আসলে ইলম পরিভাষা দিয়ে ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। বিজ্ঞাননিষ্ঠ জ্ঞানকে ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে বলা হয় হিকমাহ। হিকমাহকে জ্ঞানের উচ্চস্তর তথা প্রজ্ঞাও (Wisdom) বলা হয়। ইলম ও হিকমাহ এই দুয়ের সমন্বয় না হলে দুটোই অপূর্ণ থেকে যায়। ধরুন, একজন মানুষ আগুন চিনে এবং এর দহনক্ষমতা আছে সেটাও বুঝে। তাহলে বুঝতে হবে আগুন সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে। সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রিতভাবে জাগতিক প্রয়োজনে কাজে লাগিয়ে উপযোগ সৃষ্টি করতে জানলে তাহলে বুঝতে হবে তিনি প্রজ্ঞাবান। এখানে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইলমের চেয়ে হিকমাহ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিকমাহর অভাবে ইলম কখনো কখনো অর্থহীন হতে পারে, উপকারের বদলে অপকারও ডেকে আনতে পারে। শুধু আগুন চিনলে হবে না, বিচারবুদ্ধি সহকারের আগুনের ব্যবহার না জানলে, অর্থাৎ প্রজ্ঞার অভাবে কারো পক্ষে হাত পুড়াও অসম্ভব নয়।

আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করেছেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা জুমার) বাক্যটা প্রশ্নবোধক হলেও আল্লাহ আসলে প্রশ্নের উসিলায় উত্তরই বলে দিয়েছেন। নির্জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানী অবম্যই শ্রেষ্ঠ। কী জানলে এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হবে সেটা নিয়েই আসলে যত ঝামেলা। সুরা আল ইমরানে আল্লাহ বলেছেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে নিদর্শন রয়েছে সেই সব বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে যারা দাঁড়িয়ে বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি কম্পর্কে চিন্তা করে।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এখানে বিজ্ঞান বা হিকমাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে। আমাদের অসুবিধা হলো এই যে, আলেমগণ উল্লিখিত আয়াতে নির্দেশিত বিষয় নিয়ে ভাববার প্রয়োজন অনুভব করেন না, আবার প্রজ্ঞানিষ্ঠ ভাবুকরা আল্লাহকে স্মরণ করতে চান না, কেউ কেউ তো আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই দ্বিধান্বিত।

দেশের সুপরিচিত ও তুমুল জনপ্রিয় একজন ওয়াজকারীর একটি বক্তব্য শোনার পর আমার মনে এই সমন্বয়বাদী ভাবনাটা জোরালো হয়ে উঠেছে। একমুখী জ্ঞানের কারণে তিনি সত্যি বিপত্তির সৃষ্টি করেছেন।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে, যে-কোনো ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকার পরেও তিনি মাহফিল করেছেন। তিনি কসম কেটে বলেছেন, জামাতে নামাজ পড়ে এমন মুসলমানকে করোনা স্পর্শ করতে পারে না। যদি করে তাহলে কুরআন মিথ্যা হয়ে যাবে (নাউজু বিল্লাহ)। কুরআন কোথায় এই গ্যারান্টি দিয়েছে তার রেফারেন্স তিনি অবশ্য দেননি। মুসলিম বিশ্ব যখন করোনায় নাস্তানাবুদ তখন তার এই চ্যালেঞ্জ কুরআনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যদিও আল্লাহ কিংবা তার কুরআন মানুষের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ধার ধারেন না।

করোনা নিয়ে আমাদের আলেমদের বক্তব্য খুব ইন্টারেস্টিং। চীন-আমেরিকা-ইউরোপ হয়ে করোনা মুসলিম বিশ্বের দিকে এগিয়েছে। করোনার গতিবিধি অনুযায়ী আলেমরা তাদের বক্তব্য পুনর্বিন্যাস করেছেন। প্রথমে তাঁরা করোনাকে মুসলিমবিদ্বেষীদের ওপর আল্লাহর প্রতিশোধ হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। পরে সেখান থেকে সরে সেটাকে মুসলমানদের জন্যে আসমানী গজবের তকমা দিয়েছেন। এই বিপদের দিনেও তাঁদের অনেকে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ নামে কিছু নেই বলে জনগণকে আশ্বস্ত করছেন। অথচ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স)- এর জীবদ্দশায় ছোঁয়াচে রোগ ও মহামারী ছিল। তিনি কুষ্ঠরোগীর ক্ষতপূর্ণ হাত ধরে বায়াত গ্রহণ করাননি। তিনি মহামারীর সময় করণীয় সম্পর্কেও স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন যা আজকের লক ডাউন কিংবা আইসোলেশনেরই নামান্তর। সব প্লেগ বা মহামারী বিশেষ জীবাণুঘটিত রোগমাত্র। তার সবই যে খোদায়ী গজব এ কথাও বলা যাবে না। কোনটি গজব আর কোনটি গজব নয় তা তো কেবল আল্লাহই জানেন। বলা বাহুল্য, খলিফা আবু বকর (রা.) প্লেগ জাতীয় রোগে মারা গেছেন। খলিফা ওমর (রা.)-এর সময় ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ার আমোয়াস শহরের ভয়াবহ প্লেগ রোগে কমপক্ষে ২৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তখনকার দিনের ২৫ হাজার এখনকার দিনে কত হবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক সাহাবী ছিলেন। দিগ্বিজয়ী সেনাপতি আবু ওবায়দা বিন জাররাহ (রা.) এই প্লেগে মারা যান। মনে রাখা ভালো, আবু বকর (রা) ও আবু ওবায়দা (রা) ছিলেন আশারা-ই-মুবাশশারাহ বা ‘জীবিতকালেই বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত’ দশজনের মধ্যে অন্যতম।

ইউটিউবে কিছু প্রাজ্ঞ আলেমের যৌক্তিক কথাও আছে। কিন্তু তাঁদের কথা সবার কানে পৌঁছায় না, কারণ তাঁদের সস্তা জনপ্রিয়তা কম। এখনো কিছু আলেম নামধারী মানুষকে প্ররোচিত করছে মসজিদে যেতে। তারা ভাগ্যের দোহাই দিচ্ছেন, মসজিদকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। মসজিদ আল্লাহর ঘর সত্য কিন্তু সেখানে নিরাপত্তার ভার আল্লাহ নেননি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর (রা) ফজরের নামাজে ইমামতি করার সময় আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। খলিফা হযরত আলি (রা)-কেও হত্যা করা হয় নামাজরত অবস্থায়। তৃতীয় খরিফা উসমান (রা)-কে হত্যা করা হয় নামাজ পড়ার পর কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়।

আমি বেশ কয়েকদিন বাসার বাইরে যাইনি। কিন্তু ঘরে বসে থাকলেই যে আমি করোনা থেকে বাঁচতে পারব সেটার কোনো নিশ্চয়তািআছে এটাও বিশ্বাস করি না। আমার তকদিরে যদি করোনায় মৃত্যু লেখা থাকে তাহলে আমি লোহার নিশ্ছিদ্র বাক্সে ঢুকে থাকলেও রক্ষা হবে না। এটা বিশ্বাস করা ঈমানের মৌলিক অংশ। কিন্তু এই বিশ্বাস নিয়ে জনসমাগমে ঘুরে বেড়ানো হবে বোকামি ও প্রজ্ঞার পরিপন্থী কাজ। আমি বিশ্বাস করি, করোনা ভাইরাস বিষয়টি চিকৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শই পালনীয়। এ ক্ষেত্রে কোনো হুজুরের প্রেসক্রিপশন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের চেয়ে বড় হতে পারে না। এমন ভাবা প্রজ্ঞা বা হিকমাহর দাবি। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে এই প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধি আল্লাহর সেরা দান। সেটাকে কাজে না লাগালে নিজের ওপর জুলুম করা হবে। আল্লাহর দানকে উপেক্ষা করা হবে।

তকদির বা ভাগ্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ও মানুষের পক্ষে অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আল্লাহ কোনো মানুষকেই তার তকদির আগাম জানিয়ে দেননি। মানুষ যাতে তকদিরের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে না থাকে, তাকে দেওয়া সামর্থ্যের অপচয় না করে, সেজন্যেই আল্লাহ তকদিরকে অজ্ঞাত রেখেছেন। অতএব, যেহেতু আমার তকদির সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় সাবধানতা অবলম্বন করাই হবে এ সময় হিকমার পরিচায়ক। সম্ভাব্য সাবধানতা অবলম্বনের পরেও যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন বলব, এটাই আমার তকদির। আমার চেষ্টা আমি করেছি, আল্লাহ যা চেয়েছেন তা করেছেন। এতেই হয়তো আমার মঙ্গল নিহিত, এতেই আমি খুশি। কিন্তু সাবধান না হয়ে বোকার মতো চললে তিরষ্কার স্বরূপ আল্লাহ তকদির বদলেও দিতে পারেন। কারণ ভাগ্য বদলাতে আল্লাহকে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না। আল্লাহ নিজের এ এখতিয়ার সম্পর্কে কুরআনে অনেকবার বলেছেন।

একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ৬৩৯ সালে খলিফা হজরত উমর (রা.) সিরিয়ায় যাত্রা করে পথিমধ্যে যখন জানতে পারেন যে, সেখানে মহামারী শুরু হয়েছে, তখন তিনি যাত্রা বাতিল করে মদিনায় ফিরে আসেন। তখন তাঁকে বলা হলো, তিনি কি আল্লাহর তকদির থেকে পালাতে চাইছেন? জবাবে খলিফা বললেন, মোটেও না। আমি যে রওনা দিয়েছিলাম সেটা যেমন তকদির, এ-ই যে ফিরে এলাম এটাও তকদির। মিনাল কাদরি, ইলাল কাদরি। যাওয়া না যাওয়ার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে হিকমাহ। উমর (রা) এখানে দূরদর্শী প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। এ সুগভীর প্রজ্ঞা আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন বলেই তো তিনি খলিফাতুল মুসলিমিন। অদৃষ্টবাদের জজবাওয়ালারা আমিরুল মুমিনুনের চেয়েও বেশি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কাল রাখলে, তাঁর চেয়ে পোক্ত ঈমানদার হলে, আমার অবশ্য কিছু বলার নেই।

অতএব ঘরে থাকি, সাবধানে থাকি, এটাই এ সময়ের প্রজ্ঞার পরিচায়ক । আমাদের কাজ আমরা করি, বাকিটা ছেড়ে দেই আমাদের তকদিরের ওপর।

 

 

লেখক: বিভাগীয় প্রধান বাংলা, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here