বৃষ্টি শেষের জ্যোৎস্না

শুভজিৎ বরকন্দাজ

বিকেল ফুরিয়ে এসেছে।

সারাদিনের অসহ্য গরমের পর পশ্চিমের আকাশটাকে এক দঙ্গল রাগী বুনো মোষের মতো মেঘ এসে ঘিরে ফেলেছে। স্টেশন চত্তরটা পেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা খুশি হয়ে উঠল রাতুলের। এখান থেকে সাইকেলে ওর বাড়ি পৌঁছুতে প্রায় আধঘন্টারও বেশি সময় লাগে। আজ ভিজে কাক হবার দিন। কোথাও দাঁড়াতেও ইচ্ছে করছে না। একটা আগুনের হলকা নামিয়ে শীতল বাতাস শুরু করল। শরীরটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে এবার। রাতুল সাইকেলে প্যাডেল চালাল। বৃষ্টি হোক। জমিয়ে হোক। বুকের ভেতরটাও জুড়োক।

রিক্সাস্ট্যান্ড পেরিয়ে দু’পা এগোতেই চোখ আটকে গেল। ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরী। কিছুটা ঝুঁকে কাঁধের ঈষৎ ভারী ব্যাগটা সামলাচ্ছে। কত যুগ পরে যেন সে দেখল পরীকে। একুশ বছরের মেয়েটাকে পরিপুষ্ট যুবতী বলতে আর দ্বিধা হবার কথা নয়। ভাবল না দেখার ভান করে চলে যাবে। পারল না রাতুল। একঝলক দমকা বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পরীর চুলে। মুখের সামনে এলামেলো হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে চুলগুলো। রাতুলেরও বুকের ভেতরটাও এলোমেলো হয়ে গেল হঠাৎই।

পরী রিক্সার জন্যে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও রিক্সা বোধহয় পাওয়া যাবে না। এ রাস্তায় রিক্সা এমনিতেই খুব কম চলে। আজ তো বাদলার গন্ধ পেয়েছে। খানিক ইতস্তত করে রাতুল এগিয়ে গেল, আজ এলে?

পরী আগেই দেখেছিল রাতুলকে, তবু নতুন করেই যেন পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখল আর একবার, ওহ, তুমি?

হ্যাঁ। কেমন আছো।

ভালো। বলতে গিয়েও যেন কোনও এক অব্যক্ত বেদনার ছায়া এসে পড়ল পরীর মুখে। তুমি কেমন আছো?

জানি না। বলতে গিয়েও রাতুল থমকালো। বলল, ভালো। মুখ তুলে চেয়ে দেখল পরী ওর মুখের দিকে তখনও একদৃষ্টে চেয়ে। অস্বস্তি এড়াতে রাতুল কথা ঘোরাল, একা এলে? পরমুহূর্তে মনে পড়ল, একাই তো আসবে; সদ্য ডিভোর্স হওয়া পরীর কথা ভেবে গলাটা ধরে এল রাতুলের। এখন রিক্সা পাবে? আকাশের অবস্থাও তেমন ভালো না। বৃষ্টি নামবে যে!

পরী কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। মাথাটা নাড়াল শুধু। ওর কোলের ছোট্ট বাচ্চাটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতুল খুব অস্বস্তিতে পড়ল। যদি না দেখে চলে যেত তাহলে সমস্যা ছিল না, কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাবে! সেটা কি ভালো দেখায়, যেখানে একই পাড়ায় যাবে দুজনই। তাছাড়া কোলে ওর ছোট্ট বাচ্চাটা আর ওই ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা! একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে। আকাশে মেঘ দেখেও মনে হচ্ছে প্রলয় না হয়ে যায় আজকে।

আমার সঙ্গে যেতে কি খুব অসুবিধা হবে তোমার? না হলে আসতে পারো।

রাতুল দেখল পরী তখনও চেয়ে আছে ওর দিকে। আগে হলে ওর মন পড়তে পারত রাতুল। এখন কি আর সে তা পারবে! পরী এখন ওর কাছে ইতিহাস আর এই পথের দেখা মাত্র। একবার মনে হল ও খুব নিষ্ঠুর হয়ে যাবে, কে কী ভাবল তাতে ওর কিসেরই বা দায়! কিন্তু পারল না। দমকা হাওয়ার জোর বাড়তেই রাতুল আবার গলা তুলল, এসো, এখন রিক্সাও তো নেই।

পরী মাথা নাড়াল, এবারও কিছু একটা বলতে গিয়েও কথা হারাল যেন। তারপর ভারী ব্যাগটাকে কাঁধে চেপে ধরে পা বাড়াতে চাইল। রাতুল বুঝল কোলে বাচ্চা নিয়ে ভারী ব্যাগটা ওকে সমস্যায় ফেলছে। দেখে কেন জানি মায়া হল। হাত বাড়িয়ে বলল, দাও, ব্যাগটা আমার কাছে দাও।

একটু ইতস্তত করে পরী ব্যাগটা এগিয়ে দিল। রাতুল ঠিকই ভেবেছিল। যথেষ্টই ভারী। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরল ও। তারপর ওরা হাঁটতে শুরু করল।

অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তার আলোগুলো এখনও জ্বলেনি। আজ আদৌ জ্বলবে কিনা কে জানে! দমকা হাওয়ার জোর বাড়তে লাগল। মেঘে মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে মাথার ইপর আকাশটা। রাতুল বুঝল এভাবে হেঁটে গেলে ঝড় বৃষ্টি কোনটাই এড়াতে পারবে না। একটু আগে ভেজার ইচ্ছেটাও যেন মরে গেছে কখন। আগের পরী ওর হাত ধরে ভিজতে পারত। এখনকার পরী বোধহয় ভিজতে ভুলে গেছে। সঙ্গে ছোট বাচ্চা নিয়ে কোন মা আর ভিজতে চাইবে। রাতুল আর দেরী করল না। সাইকেলে উঠে বসে প্যাডেলে পা রাখল।

থমকে গিয়ে পরী পিছনে চাইল। তারপর একটু ইতস্তত করে বাচ্চাটাকে নিয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারের পিছনে এসে বসে পড়ল চুপচাপ। রাতুল প্যাডেলে চাপ দিতেই একটু টলোমলো করে সোজা হয়ে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে সাইকেল চলতে শুরু করল বাতাস কেটে।

দু’জনেই চুপচাপ। যেন কথা হারিয়েছে। সাইকেলের চাকার অস্পষ্ট ঘসটানির শব্দ আর দমকা বাতাসের হু-হু শব্দ ছাড়া কোনও শব্দই যেন নেই চরাচরে। তপ্ত বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে এসে পড়তেই রাতুল চিন্তিত হল। বেবিকে ভালো করে কাপড় দিয়ে ঢেকে নাও। কথাটা বলতে গিয়েই কেন জানি রাতুলের গা-টা কেঁপে উঠল হঠাৎ করেই। এই তো সেই কতচেনা পুরনো সাইকেল। ওরাও সেই চেনা দুইজন। এরকম বৃষ্টির সন্ধেটাও তো খুব অচেনা নয় ওদের কাছে। বৃষ্টি ভিজে শরীরে শরীর মিশিয়ে বুকের মধ্যে শিরশিরে ভালোলাগা নিয়ে ওরাও তো কম রাস্তা পেরোয়নি একদিন। তবু সেই চেনা দুটো মানুষ এত অচেনা হয়ে গেল কেন আজ এমন করে! পরীর কোলে ছোট্ট শিশুটাই দু’জনের মাঝে একটা মস্ত প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে যেন এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে আজ। কীসের যেন এক বোবা অভিমান এসে রাতুলের গলার কাছে কান্না হয়ে জমে উঠল। পরী কি জানে রাতুল আজ কতটা একা হয়ে আছে!

বাতাসের সাথে বৃষ্টির অভিমানও জমে উঠেছে ওদিকে। ঝাঁপিয়ে নামল বৃষ্টি। দিকবিদিক অন্ধকার করে। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়ার দাপটে সাইকেল চালানোই দুষ্কর। রাতুল প্রাণপনে এগোতে চাইল। কিন্তু না, এভাবে সম্ভব না। এ রাস্তায় একটা শেডও চোখে পড়ে না। বাড়িঘরও খুব কম। শেষমেষ বড়সড় একটা গাছের নীচে এসে সাইকেল দাঁড় করাল রাতুল। পরীও নেমে এসে দাঁড়াল ওর অনেকটাই গা ঘেঁসে।

বৃষ্টিও যেন আজ রাতুলের অভিমান পড়ে নিচ্ছে আশ মিটিয়ে। আবছা অন্ধকারে দু’হাত দূরের জিনিসও অস্পষ্ট হয়ে আছে। এক অনন্ত অন্ধকারের দেওয়াল তুলে যেন আজকের সন্ধেটা ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে এসে। রাতুলের নিজেকে খুব একা লাগছিল। পরীর মুখটা এখন ওর বুকের অনেক কাছে। ওর শরীরটা কি রাতুলের শরীর ছুঁয়ে ফেলল একবার? মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে পরীর গা থেকে। বৃষ্টি ভিজলে যেমন পেত ও, ঠিক সেই আগের মতো। রাতুলের চোখদুটো ভিজে এল। খুব ইচ্ছে করল কাকভেজা পরীকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে বৃষ্টিকণা গুলো ঠোঁট দিয়ে শুষে নেয় একটু একটু করে।

হু-হু বৃষ্টির দাপট বেড়েই চলেছে। কিন্তু পরী এত চুপ কেন! সীমাহীন অন্ধকারে রাতুলের চোখদুটো খুঁজতে চাইল ওর চিরচেনা সেই স্বপ্নের পরীটাকে। পরীর চোখদুটোও বুঝি তখন খুঁজে ফিরছে ওর হারানো অতীতটাকেও!

এত কাছে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে খুঁজে পাচ্ছো না পরী? রাতুল ফিসফিস করে যেন নিজের মনকেই বলতে থাকল, আমি ভালো নেই পরী। তোমাকে ছাড়া আমি খুব একা হয়ে গেছি দেখো।

কী এক অব্যক্ত ভালোলাগায় পরীর ঠোঁটদুটো একবার কেঁপে উঠল যেন। রাতুলের বুক ছুঁল এসে পরীর মাথা। ফিসফিসিয়ে সেও তখন বলছে, আমিও ভালো নেই রাতুলদা। তোমাকে ছাড়া।

বৃষ্টি কমে এসেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো অসম্ভব ব্যস্ততায় যেন বিলি কেটে চলেছে মাথার উপর দিয়ে। সাইকেলের হ্যান্ডেলটাকে ধরে সিক্তবসনা পরীকে পাশে নিয়ে রাতুল হাঁটছিল। আজ যেন কোনও ফেরার তাড়া নেই ওদের। পরীর গা থেকে সেই বৃষ্টিভেজা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আরও তীব্র হয়ে। বৃষ্টি শেষের নরম জ্যোৎস্না এখন ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের দু’জনকেই।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here