সাদিয়া নাসরিন

সাদিয়া নাসরিন :: নারীবাদ একটি সামাজিক রাজনৈতিক আদর্শ। কোনভাবেই তা ‘তুমি যা করতেসো আমিও তাই করবো’ টাইপ লজিক্যাল ফ্যালাসির উপর প্রতিষ্ঠিত না। নারীবাদ অর্থ নারী পুরুষ ইন্টারসেক্স মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, যৌন, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম অধিকার।

এবং এই অধিকার আদায়ের জন্য নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতার রাজনীতির উচ্ছেদ চায়, পুরুষতন্ত্রের বিলোপ চায় কিন্তু তার জায়গায় নারীবাদকে ক্ষমতায় আনতে চায়না না। কারণ, যে তন্ত্রে ক্ষমতার রাজনীতি আছে, সেই তন্ত্রেই বিভিন্ন রূপে বৈষম্য থাকতে বাধ্য।

ক্ষমতা বিষয়টাই এমন যে, তা যার হাতেই যাক না কেন ছুরি শাবল সে চালাবেই। পুরুষতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে নারীবাদকে ক্ষমতায় নিয়ে আসলে এতদিন পুরুষেরা নারীর উপর যেসব অত্যাচার চালিয়েছে নারীরাও সেই ক্ষমতা হাতে নিয়ে পুরুষদের উপর একই প্রকার অত্যাচার চালাবেন তাতে কোনোপ্রকার সন্দেহ নেই।

আজকে পুরুষরা যেমন ক্ষমতার মসনদে বসে ঠিক করে দেয় নারী কি বলবে, কোন ভাষায় যাবে, কি খাবে, কোথায় যাবে, নারীর পোষাক কি হবে, নারী ক্ষমতার মসনদে বসলেও একইরকম ভাবে পুরুষের চুলের দৈর্ঘ্য, দাঁড়ির স্টাইল, ভাষা, সম্পদ, যৌনতা, মোবিলিটি সব নিয়ন্ত্রণ করবে।

ঠিক এই কারনে, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দটা আমার কাছে আরো বিশ্লেষণের দাবী রাখে। কেননা, এ যাবৎ কালে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের চুড়ায় যে নারীরা পৌঁছেছেন তাদের সবাইকেই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চা করতে দেখেছি আমি। টু বি অনেস্ট, আমি নিজেও অনেক সময় পুরুষতান্ত্রিক আচরণকে রেসিস্ট করতে পারিনা।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ অবশ্যই, কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে একজন নারীর পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাও নারীবাদ বলে।

নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং স্বাধীনতার অর্থ এটা না যে, তিনি ক্ষমতার উচ্চ অবস্থানে আছেন বলেই সেটা এক্সারসাইজ করতে গিয়ে অন্যজনকে ইনইডিকুয়েট ভাববেন।

স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া, নিজের মত প্রকাশ করা, নিজের খুশিমত নিজের জন্য বাঁচা নারীবাদের মূল বিষয় অবশ্যই। কিন্তু এই স্বাধীনতা উপভোগ করতে গিয়ে অন্য লিঙ্গের স্বাধীনতা খর্ব করা, অত্যাচার, নির্যাতন, নিয়ন্ত্রণ এবং অবদমন করে নিজের মতামত এবং সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াটাও নারীবাদ নামেই আরেকপ্রকার পুরুষতন্ত্র।

বদরুল প্রেম আদায় করার জন্য খাদিজাকে কোপালে যেমন অপরাধ হয়, তেমনি খাদিজা সেই ক্ষমতা হাতে পেয়ে বদরুলকে কোপালেও একই অপরাধ হয়।

আমার মানিব্যাগের নিয়ন্ত্রণ আমার স্বামী নিলে যেমন আমার উপর অন্যায় করা হয়, তেমনি ক্ষমতা পেয়ে তার মানিব্যাগ আমি দখল করলেও একই অন্যায় হয়।

আমাকে একা সন্তান পালনের বাধ্যতা দেওয়া, একা রান্নাঘরে ঢুকতে বাধ্য করাটা যদি নিপিড়ন হয়, তেমনি আমি যদি আমার স্বামীকেই রান্না করা বাচ্চা পালা সব করতে দিয়ে সোফায় বসে পা নাচিয়ে নাচিয়ে টক শো দেখি সেটাও তার প্রতি নিপিড়ন হয়।

পুরুষ যে ভাষায় নারিকে গালাগাল দেয়, চরিত্রহনন করে, তার নাম যৌন নির্যাতন হলে, নারী যখন পুরুষকে একই ভাষায় গালাগাল দেয় সেটাও যৌন নির্যাতন হয়।

নারীবাদী এ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে নিজের শক্ত অবস্থান প্রমাণ করতে গিয়ে কোন ভিকটিমকে তার ইমোশনাল ভালনারেবিলিটির সময়ে “ভুল মানুষ পছন্দ করার জন্য” থাপ্পর দিতে চাওয়াটা অবশ্যই একটি পুরুষতান্ত্রিক আচরণ।

সুতরাং নারীবাদ অবশ্যই প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা থেকে উৎসরিত দমন নিপিড়ন অবিচার বৈষম্যের বিপক্ষেই হতে হবে। হোক তা পুরুষের হাতে কি নারীর হাতে। স্বৈরাচারিতা, সেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতা দিয়ে নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত করে আর যাই হোক মানুষের মুক্তি আসবেনা।

এবং সেই নারীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে প্রস্তুত হতে হবে নারীকেই। এটি দুরূহ কাজ।

 

 

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here