নুষ্ঠানের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

স্টাফ রিপোর্টার ::সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত ৯ বছরে বজ্রাঘাতে মারা গেছেন এক হাজার ৯৯৮ জন। বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিলেও এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও এলাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও ভূমিকা রাখতে হবে।

মঙ্গলবার রাজধানীর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘বজ্রপাত ঝুঁকি নিরসন ও করণীয়’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে ব্র্যাক হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রাম।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। তিনি বলেন- বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়সহ যেকোনো দুর্যোগের পূর্বাভাস যেন আরও আগে পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর কাজ চলছে। এতে আবহাওয়াগত প্রযুক্তির বিষয়টি আরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে সারাদেশে ৫০ লাখ তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে ৩৮ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে। তবে তালগাছ খুব ধীরে বাড়ে। এ জন্য সরকার বিকল্প পদ্ধতি বা ব্যবস্থা নিয়েও ভাবছে।

বজ্রপাতের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের তথ্য তুলে ধরে ডা. এনামুর বলেন, বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় করে তুলতে জাপানের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০৭০ সাল নাগাদ দেশ ভূমিকম্প সহনীয় হয়ে উঠবে। তখন ১০ মাত্রার ভূমিকম্পেও কোনো ক্ষতি হবে না।

বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিন। তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করছে সরকার। গত ৯ বছরে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন এক হাজার ৯৯৮ জন। বজ্রপাতের ঝুঁকি কীভাবে আরও প্রশমন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সরকার উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে এ বিষয়ে।

তিনি বলেন, বজ্রপাত নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের মাঝে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এবার সুনামগঞ্জের হাওরে ধান কাটার জন্য শ্রমিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ধরনের পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি কার্যক্রমের কথাও জানান তিনি।

বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রামের পরিচালক সাজেদুল হাসান। তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব ঘটনার তথ্য পরিসংখ্যানে আসে না। দিন দিন বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পূর্বাভাস আরও বাস্তবসম্মত এবং তথ্যনির্ভর হলে ঝুঁকি কমে আসতে পারে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করতে চায় ব্র্যাক। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ব্র্যাক এ উদ্যোগে সরকারের সঙ্গে থাকবে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার মাহবুব হাসান। তিনি বলেন, বজ্রপাতের ঝুঁকি এবং বাস্তবতা অন্যান্য দুর্যোগের মতো দৃশ্যমান না হওয়ায় এ নিয়ে আলোচনা কম হয়। সরকারি হিসাবে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৪৭৬ জন। বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে, সংখ্যাটি আরও বড়। দুই মাস পরেই ফের সেই পরিস্থিতি আসছে। গবেষণার পাশাপাশি সচেতনতা এবং ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

বৈঠকে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন বজ্রপাতে আহত সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দুই বাসিন্দা হোসেন মিয়া ও সাইদুর রহমান। দিরাই উপজেলা পরিষদের দুই ভাইস চেয়ারম্যান মোহন চৌধুরী এবং রিপা সিনহাও বক্তব্য রাখেন।

বজ্রপাতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বলেন, একসময় দেখা যেত নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বজ্রপাত হয়। এখন তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বজ্রপাতের সময়েও এসেছে পরিবর্তন। খোলা মাঠে অবস্থানরত মানুষই সবচেয়ে উঁচু, তাই মানুষের ওপর বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে। তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে বজ্রপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধির একটি যোগসূত্র রয়েছে।

স্টার্ট ফান্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সাজিদ রায়হান বলেন, অন্যান্য দুর্যোগ থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এই ঝুঁকি নিরসনে সচেতনতা খুবই জরুরি। গবেষণাধর্মী উদ্যোগ বাড়াতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। শীত শেষেই বজ্রপাতের মৌসুম শুরু হবে। সুতরাং প্রয়োজনীয় তৎপরতা নিতে হবে এখনই।

ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের রিসার্চ ফেলো ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপনে ঝুঁকি কমে না। কারণ, বজ্রপাত আঘাত করলে সেটি মাটির ওপরে ছড়িয়ে পড়ে। ঝুঁকির আরও নানা কারণ রয়েছে। নাসাও এ বিষয়ে কাজ করছে। বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে অ্যাপ বানানোর চেষ্টা চলছে। এর মাধ্যমে অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে জানা যাবে কোথায় বজ্রপাত হবে। হুঁইসেল পদ্ধতিসহ নানা প্রযুক্তিতে জাপান এ বিষয়ে সফলতা পেয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশেও তা অনুসরণের পরামর্শ দেন তিনি।

ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের পরিচালক (আইসিটি অ্যান্ড ইনোভেশন) মুশফিকুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, বজ্রপাত পূর্বাভাস পদ্ধতি আরও জোরালো করতে পারলে ঝুঁকি কমে আসবে। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শনাক্তকরণ যন্ত্র তৈরি করে তা স্থাপন করলে বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে পূর্বাভাসের আওতায় আনা যেতে পারে। এ বিষয়ে তাদের কয়েকটি গবেষণা চলমান রয়েছে।

ইউনিসেফের ডিআরআর বিশেষজ্ঞ আনোয়ার হোসেন বলেন, বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ কৃষক বা জেলে। এখানে বড় একটি অংশ রয়েছে শিশু। ইউনিসেফ সব সময় তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। বৃক্ষনিধন এবং বায়ুদূষণের কারণেও বজ্রপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রামের পরিচালক মোস্তাক হুসাইন বলেন, অন্য দুর্যোগের সঙ্গে বজ্রপাতের আলোচনাকে আরও প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পূর্বাভাস ব্যবস্থা চালু হলে এর সুফল আসবে। হাওরের উঁচু জায়গায় হিজল গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।

একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার রাকিব হাসান বলেন, ২০১৮ সালের এপ্রিলে এক মাসেই ৫০ জনের বেশি মানুষ মারা যান। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও তারা ঘর থেকে বের হন। আবার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও ঝুঁকি বেশি এখানে। ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে দেশে এখনও সমন্বিত গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। দেশের মেধাবী তরুণরা এ বিষয়ে গবেষণায় যথেষ্ট আগ্রহী হলেও তারা বাধ্য হয়ে বিদেশে চলে যান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here