৪ ডিসেম্বর ১১ নং সেক্টরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়াকামালপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয় পাকসেনা। শত্রুমুক্ত হয় ১১নং সেক্টরের ধানুয়াকামালপুর রণাঙ্গন। স্বাধীন বাংলার আকাশে উড়ে বিজয়ী পতাকা।
১৯৭১সালের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলে ১১নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এই সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন, কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তম। বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর থেকে ২ কিঃমিঃ দুরে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল। যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে ১১নং সেক্টরকে মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকারচর, পুরাকাশিয়া, ডালু, বাগমারা, শিববাড়ী, রংড়া ও মহেশখোলা এই আট ভাগে বিভক্ত করা হয়। ধানুয়াকামালপুরে ছিলো একটি শক্তিশালী পাকসেনা ঘাঁটি। এই সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর ৩ হাজার ও ১৯ হাজার গণবাহিনীসহ মোট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ২২ হাজার। এই সেক্টরে ১২ জুন থেকে ২৮ নভেন্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকসেনাদের বিভিন্ন সময়ে ১০ বার সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ মোট ১৯৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৪৯৭ জন পাকসেনা।
১৩ নভেম্বর কর্ণেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে কোম্পানী কমান্ডার লেঃ মিজান, ক্যাপ্টেন মান্নান, মুক্তিযোদ্ধা সাইদ কোম্পানী ও ভারতীয় বাহিনীর ২টি কোম্পানী আর্টিলারী সাহায্যে রাতে কামালপুর শত্রম্ন ক্যাম্পে পরিকল্পনা মাফিক আক্রমন করা হয়। এই সম্মুখ যুদ্ধে কামালপুরে শক্রপক্ষের ১ জন মেজরসহ ২ কোম্পানী পাকসেনা নিহত হয়।
১৪ নভেম্বর পাকসেনাদের একটি মর্টার সেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আবু তাহের আহত হন। পরে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, উইংকমান্ডার হামিদুল্লাহ খান। সামরিক অভিযানের পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী ২৪ নভেম্বর থেকে কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্প অবরোধ করে রাখেন মুক্তিযোদ্ধারা।
৩ ডিসেম্বর যৌথকমান্ডের সিদ্ধান্ত মতে অবরুদ্ধ পাকসেনা ক্যাম্পে একটি চিঠি পাঠানো হয়। বকশীগঞ্জের বৈষনব্ব পাড়ার অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ বীর প্রতীক মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে ঐতিহাসিক সেই চিঠি নিয়ে পাকসেনা ক্যাম্পে হাজির হন। চিঠিতে লেখা ছিল তোমাদের চারদিকে যৌথবাহিনী ঘেরাও করে রেখেছে। বাচঁতে চাইলে আত্মসর্মপণ কর, তা না হলে মৃত্যু অবধারিত। এই চিঠি পেয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে পাকসেনা কমান্ডার আহসান মালিক। কিন্ত অবস্থা বেগতিক দেখে অবরম্নদ্ধ কমান্ডার বীর বশিরকে না মেরে আটক রাখে। অন্য দিকে বশিরের ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা চিন্তাগ্রস্ত হয়। সবার ধারনা বশিরকে মেরে ফেলেছে তারা। তাই আক্রমনের জন্য সবাই প্রস্তত।
ক্ষনিকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়ে আরেকটি চিঠি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জুকে পাঠানো হয় পাকসেনা ক্যাম্পে। জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে বীরদর্পে দ্বিতীয় চিঠি নিয়ে সঞ্জু শক্রক্যাম্পে যায়। সেই চিঠিতেও লেখা ছিল উপায় নেই বাচঁতে হলে আত্মসর্মপন করতে হবে। সেই চিঠিরও কোন জবাব না দিয়ে সঞ্জুকে আটক রাখে পাকসেনারা। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিত হয় পাকসেনারা বশির ও সঞ্জুকে মেরে ফেলেছে।
তাই বিজয়ী হতে হলে যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই। এই ভেবে হামলার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। তখন অবস্থা বুঝতে পেরে গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিকসহ বেলুচ, পাঠান ও পাঞ্জাবী সৈন্যের ১৬২ জনের একটি দল আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসর্মপন করে। শক্র মুক্ত হয় বকশীগঞ্জের ধানুয়াকামালপুর। বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর ও সঞ্জু বাংলার লাল সবুজের বিজয়ী পতাকা উত্তলন করেন কামালপুরের মাটিতে। ধানুয়া কামালপুর থেকেই মিত্র বাহিনী বিজয়ের পতাকা নিয়ে বকশীগঞ্জ শেরপুর জামালপুর ও টাংগাইল শক্রমুক্ত করে ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার ও মেজর জেনারেল নাগরা প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেন ।
এর পর থেকে প্রতিবছর ধানুয়াকামালপুর এইদিনে মুক্তদিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/ছাইদুর রহমান/জামালপুর