পাহাড়-ধসেস্টাফ রিপোর্টার :: দুই দিনের টানা বর্ষণে বিপর্যয় নেমে এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগের তিন জেলায়। তিন জেলায় পাহাড়ধসে সেনা সদস্যসহ এ পর্যন্ত ১১০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সর্বশষ তথ্য অনুযায়ী রাঙামাটিতে ৭৬ জন, চট্টগ্রামে ২৭ এবং বান্দরবানে সাতজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

মঙ্গলবার ভোর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৭৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এখনও উদ্ধার কাজ চলছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্ধারকর্মীরা।

নিহতদের মধ্যে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে মারা যান দুই কর্মকর্তাসহ ছয় সেনা সদস্য। এ সময় আহত হন বেশ কয়েকজন। তবে এখনও কয়েকজন মাটিচাপায় আটকে আছে বলে জানা গেছে। তাদের উদ্ধারে অভিযান চলছে। তবে আইএসপিআর’র পক্ষ থেকে চারজন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ একজন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১০ জন।

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর এবং ইসলামপুর ইউনিয়নে পাহাড়ধসে ১৯ জন মারা গেছেন।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামাল হোসেন ১৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ১৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নিহতদের সবার বিস্তারিত নাম ও পরিচয় জানাতে পারেননি তিনি।

মঙ্গলবার ভোর ৪টায় চন্দনাইশের দুর্গম এলাকা দোপাছড়ি ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের শামুকছড়িতে পাহাড়ধসে এক শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছেন।

নিহতরা হলেন শামুকছড়ির শিশু মাহিয়া(৩), ছনবনিয়ার ২নং ওয়ার্ডের উপজাতি এলাকার সিনসাও কেয়াংয়ের স্ত্রী মোকা ইয়ং কিয়াং (৫০), কেলাও অং কেয়াংয়ের কিশোরী কন্যা মেমো কেয়াং (১৩) ও ফেলাও কেয়াংয়ের শিশু কন্যা কেওচা কেয়াং (১০)।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার থেকে ওই এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে সোমবার রাত ২টার পর ভারী বৃষ্টি ও সঙ্গে বজ্রপাতসহ ঝড়ো হাওয়া হয়। এরপরই এই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।

এদিকে রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, প্রবল বর্ষণে বাড়িঘরে পাহাড়ের মাটিচাপায় রাঙামাটি শহরের রিজার্ভবাজার, ভেদভেদী, শিমুলতলী, মোনঘর, রাঙামাটি ও মানিকছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে ২৫ জন, কাউখালীর বেতবুনিয়ায় চারজন, ঘিলাছড়িতে তিনজন, কাশখালীতে তিনজন এবং কাপ্তাই রাইখালীর কারিগর পাড়ায় চারজন নিহত হয়েছেন।

এছাড়া মানিকছড়িতে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটি অপসারণের সময় ছয় সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়।

তারা হলেন, মেজর মাহফুজ, ক্যাপ্টেন তানভীর আহমেদ, সিপাহী আজিজ, শাহীন, ল্যান্স কর্পোরেল আজিজ, সিপাহী মামুন। তারা রাঙামাটি সেনা রিজিয়নে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েক সেনা সদস্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রাঙ্গামাটি এবং ঢাকায় ভর্তি করা হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে রুমা আক্তার (২৫), নুর আক্তার (৩), হাজেরা (৪০), সোনালি চাকমা (৩০), এক বছর বয়সী শিশু অমিয় কান্তি চাকমা, আইয়ুশ মল্লিক (২), চুমকি মল্লিক (২), লিটন মল্লিক (২৮), অজ্ঞাত (২২), মিন্টু ত্রিপুরা (৪৫), আবদুল আজিজ (৫৫), অজ্ঞাত (৩২), মিলি চাকমা (৫৫), ফেন্সি চাকমা (৪)।

কাউখালীর যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন ফাতেমা বেগম (৬০), মনির হোসেন (২৫), মো. ইসহাক (৩০), দবির হোসেন (৮৪), খোদেজা বেগম (৬৫), অজিদা খাতুন (৬৫), মংকাচিং মারমা (৫২), আশেমা মারমা (৩৭), শ্যামা মারমা (১২), ক্যাচাচিং মারমা (৭), কুলসুমা বেগম (৬০), বৈশাখী চাকমা (১০), লায়লা বেগমের (২৮) মরদেহ উদ্ধার করে রাঙামাটি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এদিকে কাপ্তাই রাইখালীর কারিগর পাড়ায় নিহত চারজনের নাম তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। এর আগের দিন সোমবার রাঙামাটি শহরের পুলিশ লাইন এলাকায় এক শিশু এবং কাপ্তাইয়ের নতুন বাজারে এক শিশু পাহাড়ের মাটিচাপায় মারা যায়। এছাড়া কর্ণফুলী নদীতে পড়ে ইকবাল নামের এক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন।

এদিকে সোমবার রাত থেকে রাঙামাটি শহরের অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া রাঙামাটির সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। এতে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

আমাদের বান্দরবান প্রতিনিধি এনামুল হক কাশেমী জানান, টানা ৪দিনের প্রবলবর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে পাহাড়ধসে মা-মেয়সহ নিহত হলেন শিশুসহ ৬জন। সোমবার রাত থেকে বান্দরবান জেলায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পানি বন্দি। মাতামুহুরী, সাংগু এবং বাকঁখালী নদীতে পানি বিপদসীমার ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। প্রবল বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা বন্যায় কবলিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।

জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক সাংবাদিকদের জানান, মংগলবার ভোররাতে প্রবলবর্ষণে পাহাড় ধসে ঘরচাপায় জেলা শহরের অদুরে লেমুঝিরি এলাকা শ্রমিক আলমরে স্ত্রী কামরুন্নাহার (৪০) ও তার কন্যা সুফিয়া বেগম (৮), কালাঘাটা এলাকায় রেভা ত্রিপুরা (২২) মিটু বড়য়া (৫),তার বোন শুভ বড়-য়া (৪) এবং লতা বড়-য়া (৭) নিহত হয়েছেন।

পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে।  ঘনটাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক এবং সরকারি কর্মকর্র্তাসহ জনপ্রতিনিধিরা।

জেলার নানাস্থানে প্রধান সড়ক ও কয়েকটি সেতু বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সোমবার রাত থেকে বান্দরবান জেলা সদরের সাথে চট্টগ্রাম ও রাংগামাটিসহ সারাদেশের সড়কপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলার অপর ৬টি উপজেলা সদর ও জেলা সদরের মধ্যে সড়ক  যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সোমবার সন্ধ্যা থেকেই। জেলা শহরসহ ৭টি উপজেলায় ২দিন ধরে বিদ্যুত ও পানি সরবরাহ বন্ধ। মোবাইল কোম্পানীগুলোর নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়েছে গত সোমবার বিকেল থেকে।

জেলা প্রশাসন সুত্র জানায়, জেলায় প্রায় ৪০টি অস্থায়ী বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেইসব আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত বন্যাদুগতদের মাঝে শুকনা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here