একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২৪ বছরেও নৌকার পাল উড়েনি হাতিয়ায়, এবার কি উড়বে?রফিকুল আনোয়ার:: বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মোহনায় গড়ে উঠা ১৫০০ শতাব্দীর দিকের সেই দ্বীপটিই আজকের হাতিয়া। যেটি নোয়াখালী জেলার একটি উপজেলা। প্রমত্তা মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির প্রচন্ড দাপটের মুখে হাতিয়ার প্রকৃতির ভাঙ্গা গড়ার কারণে একশ দেড়শ বছরের পুরাতন কোন নিদর্শন আর নেই।

এক সময়ের হাজার হাজার বর্গকিলোমিটারের হাতিয়া এখন প্রায় ১৫০০ বর্গ কিলোমিটার। পর্যটকদের কাছে এটি অপরূপ সৌন্দয্যের লীলাভূমি হলেও স্থানীয়দের মাঝে নেই কোন আত্মতৃপ্তি বা সুখ। এই বিশাল বাড়ির মালিক একটু পরে তা ভেঙ্গে সাগরে। ঘরের একমাত্র উপার্জন কর্তা এই বাজারে গেলো, তিনদিন পরে তার লাশ পাওয়া গেলো সাগরের কোন এক কোণায়। এই হলো তিলোত্তমা হাতিয়ার বৈশিষ্ট্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড় তুফান যাদের নিত্যসঙ্গী সেই মানুষগুলোর নাগরিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে রাজনীতিবিদরা বারবার।

এক কথায় অনগ্রসর এই জনপদকে সমৃদ্ধশালী করতে এগিয়ে আসেনি স্থানীয় কোন রাজনীতিবিদ। স্বাভাবিকের চেয়ে সরকার কর্তৃক অস্বাভাবিক বরাদ্ধ থাকলেও তা চলে যায় রাজনীতিবিদদের পকেটে। শতশত কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পাকাকরণের উদ্যেগ সরকার নিলেও তা কেন যেন হচ্ছে না। স্বাধীনতার পর হাতিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস যতটা না সহজ সরল সমীকরণে ছিল আশির দশকের পর তা আর মিলছে না কোনভাবেই।

হাতিয়ার সংগ্রামী পরিশ্রমী মানুষগুলো যখনি যে যায়, তাকে বিশ্বাস করে পবিত্র আমানত ভোটটি তাদের হাতে তুলে দেয়। নির্বাচনের পর ঢাকার ধানমন্ডি, বারিধারা কিংবা গুলশানে নেতার আলিশান বাড়ি হলেও ভোটারদের বাড়ী ভেঙ্গে সাগরে বিলীন হয়। এরশাদ আমলে প্রচন্ড দাপটশালী আজীবন আওয়ামী বিদ্বেষী মোহাম্মদ আলী জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও হাতিয়ার উন্নয়নে তার কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি এখন হাতিয়ার আওয়ামীলীগ একাংশের বড় নেতা।

তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ২০১৪ (বিরোধীদল বিহীন নির্বাচন) ছাড়া কোন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকায় ভোট দেননি। তিনি ৮৬ ও ৯১-এ জাতীয় পার্টি এবং ৯৬ ও ২০০১-এ স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। ১৯৯১ সালে এই আসন থেকে আওয়ামীলীগের নৌকা মার্কায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহ। তিনি ৯৬ তে দলীয় প্রার্থী ছিলেন।

৯১ তে নির্বাচিত হলেও ৯৬ তে নির্বাচিত হতে পারেননি মোহাম্মদ আলীর কারণে। সেসময় মোহাম্মদ আলী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। সেবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির ফজলুল আজিম। ২০০১ সালে আওয়ামীলীগের প্রার্থী অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ আলীর কাছে পরাজয় বরণ করেন। ২০০৮ সালে ঋণ খেলাপীর কারণে মোহাম্মদ আলীর প্রার্থীতা বাতিল হলে নির্বাচনী লড়াই হয় দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী আয়েশা আলী ও ফজলুল আজিমের মধ্যে।

২০১৪ সালে বিরোধীদল বিহীন নির্বাচনে আয়েশা আলীর নৌকার বিপরীতে প্রার্থী হয়েছিলেন আমিরুল ইসলাম আমির। ৯১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নির্বাচনগুলো ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সব নির্বাচনেই আ’লীগের জয়লাভের শতভাগ সম্ভাবনা ছিল।

২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের কারণে এবং অপরাপর জাতীয় নির্বাচনগুলো মোহাম্মদ আলীর স্বতন্ত্র প্রার্থীতার কারণে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছিল। একাধিক দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত হাতিয়ায় যেখানে নৌকাই জীবন যাত্রার একমাত্র ভরসা সেখানে জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পাল উঠেনা আওয়ামীলীগের কতিপয় নেতার কারণে। আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত জলদস্যু, বনদস্যু নিধনের নামে এবং দলীয় কোন্দলের কারণে প্রায় দু’শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন। আহত কিংবা পঙ্গু হয়েছেন প্রায় অনেক লোক। হাতিয়ায় খুন খারাপি, রাহাজানি নিত্যদিনকার ব্যাপার। এখানে দু’একটি ঘটনার আলোকপাত করলেই তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে।

১৩ এপ্রিল ২০১৭ অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহর লোকজন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বসতঘরে হামলা চালালে নুর আলম (৩৫) ও বাহার সরকার (৪৫) মারা যায়। এই ঘটনায় আহত হয় ১০ জন। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে আলী-ওলী গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগ উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেলসহ প্রায় ১৫ জন আহত ও গুলিবিদ্ধ হয়। ২৪ শে মার্চ চরকিং ইউপিতে মোহাম্মদ আলী ও মহিউদ্দিন গ্রুপ এর সংঘর্ষে আহত হয় প্রায় ১৫ জন। ৩০ মার্চ চর ঈশ্বর ইউনিয়নের আপাজিয়া বাজারে মোহাম্মদ আলী সমর্থিত লোকজন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিনের উপর সরাসরি গুলি করে, এতে মহিউদ্দিনের ভাই যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আশরাফ উদ্দিনসহ গুলিবিদ্ধ হয় ১২ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে আশরাফ উদ্দিন মারা যায়। এরকম হাজারো ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে হাতিয়াতে।

সর্বশেষ, ঈদের দুইদিন আগে ৩০ শে আগষ্ট সোনাদিয়া ইউনিয়নের সেতু মার্কেটের সামনে মোহাম্মদ আলী সমর্থকরা কুপিয়ে যুবলীগ কর্মী রিয়াজ উদ্দিনকে হত্যা করে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, হাতিয়া রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য জলন্ত আগ্নেয়গিরি। আর নেতাদের জন্য স্বর্গসুখ। একসময়ে বিএনপির পরবর্তীতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন আওয়ামীলীগ কর্মীরা ত্রিমুখী নির্যাতন সহ্য করতেন। মোহাম্মদ আলী গ্রুপের কর্মী হলে তার কাছে ভয় থাকত আওয়ামীলীগের ওয়ালী উল্লাহ গ্রুপ ও ফজলুল আজিম গ্রুপের হামলা মামলার। একই আতঙ্কে থাকত ওয়ালী উল্লাহ গ্রুপের কর্মীরাও।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, হাতিয়ার প্রায় ৮০শতাংশই সংঘর্ষ হয়েছে আওয়ামীলীগ দলীয় কোন্দলে। ফজলুল আজিম যখন সংসদ সদস্য ছিলেন তখন তার নির্যাতনও সইতে হয়েছে আওয়ামীলীগ

নেতাকর্মীদের। বর্তমানে আওয়ামীলীগের সাথে প্রতিপক্ষের দলীয় সংঘাত নাই বললেই চলে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নোয়াখালী-৬ হাতিয়া আসনে এক ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা কোন পক্ষে যাবেন তা তারা পরিষ্কার করতে ভয় পাচ্ছেন। আলী আর ওলী দুইজনের একজনের চোখে কালার হলে আর যেন রক্ষা নেই। হয়ত নিহত না হয় আহত। সব মিলিয়ে হাতিয়ায় রাজনীতির বেহাল অবস্থা।

হাতিয়ায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেখানে দলীয় কোন কর্মসূচী নেই। নেতাদের আসা যাওয়ার মহড়াই দলীয় কর্মসূচীর অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। এলাকার প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রকৌশলী ফজলুল আজিম ৪ বছর পর ঈদের দু’একদিন আগে হাতিয়ায় গেলেন। হাতিয়ায় গিয়ে তিনি খুব একটা খুশী হতে পারেননি। মোটর সাইকেলের বহর কিংবা নেতা কর্মীদের মুহুর্মুহু স্লোগান লক্ষ্য করা যায়নি। শ’কয়েক মেসেলম্যান যারা ফজলুল আজিমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিংবা তার থেকে সুবিধা প্রাপ্ত তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রমতে এবং সরকারের বিভিন্ন এজেন্টের তথ্যমতে হাতিয়ায় আওয়ামীলীগ দলীয় কোন্দল হানাহানি সম্পর্কে দলের হাই কমান্ড নিশ্চিত হয়েছে। ইতিপূর্বে একাধিক সংবাদ মাধ্যমে হাতিয়ার বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা আলী আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন না বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদের কিছুটা সত্যতা ইতিমধ্যে আঁচ করা গেছে। হাতিয়ার বিশিষ্ট সমাজসেবক যিনি হাতিয়াতে একাধিক স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠিত পোষাক ব্যবসায়ী মাহমুদ আলী রাতুলের সরব উপস্থিতিতে। গত ১৫ আগষ্টে উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নকে ৩ ভাগ করে এবং উপজেলা সদরে একটি সেন্টার করে গরু ছাগল ভেড়া মিলে ৬০টি পশু দিয়ে কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করেন।

পক্ষান্তরে মোহাম্মদ আলী কিংবা আয়েশা আলীর পক্ষে কোন কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করা হয়নি। পবিত্র ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে ঈদের দুইদিন পূর্ব থেকে হাতিয়ায় অবস্থান করে মাহমুদ আলী রাতুল হাতিয়াবাসীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন এবং যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন সভা সমাবেশে।

আওয়ামীলীগ, কৃষকলীগ, আলেম সমাজের সাথে মত বিনিময় করছেন। মত বিনিময় করছেন হাজার হাজার দু:স্থ মহিলার সাথে। সাহায্য ও সহযোগিতা করছেন অকাতরে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাই মাহমুদ আলী রাতুলের সক্রিয়তা অনেকে আয়েশা আলী যে মনোনয়ন পাচ্ছেন না তার প্রাথমিক পূর্বাভাস বলে জানিয়েছেন। আয়েশা আলী কিংবা মোহাম্মদ আলীকেও অনেকটা নিষ্কৃয় দেখা গেছে। ঈদ-উল-আযহাতে তার দুজন হাতিয়াতে যাননি। নেননি নেতাকর্মীদের খোজখবরও।

বিভিন্ন সূত্রমতে, দলের হাই কমান্ড আগামী নির্বাচনে হাতিয়ায় এমন একজনকে দলীয় প্রার্থী হিসাবে চান যিনি দল মতের উর্দ্ধে থেকে সব কোন্দলের অবসান ঘটিয়ে নেতাকর্মীদের এক কাতারে আনতে পারবেন। দলের হাই কমান্ডের প্রাথমিক এ চাওয়ায় মাহমুদ আলী রাতুল অনেকটা উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন বলে রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করেন। হাতিয়া আওয়ামীলীগ রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহ আজ রাতুলের কাতারে। রাতুলের সাথে তিনি অংশ নিচ্ছেন প্রতিটা কর্মসূচীতে। হাতিয়ায় ৯ ইউনিয়নের ৬টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজ রাতুলের সাথে ঐক্যবদ্ধ।

তাদের মতে বিভক্ত আওয়ামীলীগ নয় আমরা হাতিয়ায় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামীলীগ চাই। এ প্রসঙ্গে সোনাদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, হাতিয়ায় যারা আওয়ামীলীগ করে তারা সকলে মাহমুদ আলী রাতুলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ, আমরা আশা করি দলের হাই কমান্ড হাতিয়ায় মাটি ও মানুষের স্বার্থে জলদস্যু বনদস্যুদের প্রত্যাখান করে প্রকৃত বঙ্গবন্ধু প্রেমিককেই আগামীতে দলের মনোনয়ন প্রদান করবেন।

তিনি দাবী করেন মাহমুদ আলী রাতুল সজ্জ্বন ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ, যার মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ কিছু নেই। তিনি দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মানব কল্যাণে নিজকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি হাতিয়াবাসীকে দিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি মাহমুদ আলী রাতুলের হাতে আওয়ামীলীগ নিরাপদ ভেবেই হাতিয়ায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, ২৪ বছর পর সাগর কন্যা হাতিয়ায় কে বিজয়ের বেশে উড়াবে নৌকার পাল তা নির্ভর করছে একমাত্র দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপর। দেখা যাক, মুল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপের নৌকার বৈঠা শেখ হাসিনা কার হাতে তুলে দেন তা দেখার বিষয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here