রহিমা আক্তার মৌ :: পৃথিবীর সকল প্রাণেরই উৎস পানি এবং সকলেই পানির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ আজ খাদ্য ও জ্বালানির মতো মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি যে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তা হচ্ছে সবার জন্য বিশুদ্ধ ও পর্যাপ্ত নিরাপদ খাবার পানি। যতই দিন যাচ্ছে গোটা বিশ্ব পানির জন্য মানুষে মানুষে দেশে দেশে সংঘাত বাড়ছে। সংঘাত নয় চাই স্থায়ী সমাধান। এর জন্য প্রয়োজন পানির ন্যাংসঙ্গত হিস্যা নিশ্চিত এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা।

১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব জল দিবস বা বিশ্ব পানি দিবস (ইংরেজি: World Day for Water বাWorld Water Day) হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতেরাষ্ট্রসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালিত হয় এবং তার পর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

রাষ্ট্রসংঘের সদস্য দেশগুলি এই দিনটিকে নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমার মধ্যে রাষ্ট্রসংঘের জলসম্পদ সংক্রান্ত সুপারিশ ও উন্নয়নপ্রস্তাবগুলির প্রতি মনোনিবেশের দিন হিসেবে উৎসর্গ করেন। প্রতি বছর বিশ্ব জল দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন সংস্থার যে কোনো একটি বিশেষ কর্মসূচি পালন করে থাকে। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রসংঘ-জল বিশ্ব জল দিবসের থিম, বার্তা ও প্রধান সংস্থা নির্বাচনের দায়িত্বে রয়েছে।

রাষ্ট্রসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও পরিচ্ছন্ন জল ও জলসম্পদ রক্ষা সম্পর্কে জনসচেতনা গড়ে তোলার জন্য এই দিন বিশেষ কর্মসূচির আয়োজন করেন। ২০০৩, ২০০৬ ও ২০০৯ সালে রাষ্ট্রসংঘ বিশ্ব জল উন্নয়ন প্রতিবেদন বিশ্ব জল দিবসেই প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অথচ নদনদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে পানি সংকটে ভুগছে জনগণ। অন্যদিকে নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের হারও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। সবার কাছে সুপেয় পানি পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিবছর ২২ মার্চ দিবসটি পালন করা হয়। যে পানি হলো জনগণের জীবন সেই পানিই এখন সারা বিশ্বের প্রধানতম সমস্যা। ৭০০ কোটি মানুষের বিশ্ব প্রায় একশ’ কোটিরও বেশি মানুষ এখন সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত।

আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সম্পদপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ক্রমেই মিঠা পানির উৎসও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর শতকরা ৭১% পানি হিসেবে থাকলেও এর মাত্র ৩% খাবার যোগ্য যার বিরাট অংশই এন্টার্কটিকা ও গ্রীনল্যান্ডে বরফ হিসেবে জমা আছে অথবা মাটির নীচে। হিসেব করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ০.০১ শতাংশ মানুষের ব্যবহারোপযোগী। তাও আবার পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে।

আধুনিক বিশ্বে যখন বিজ্ঞানের জয় জয়কার সেখানে প্রায় ১৫০ কোটিরও বেশী মানুষের জন্য নাই নিরপদ পানির ব্যবস্থা, আর প্রতি বছর শুধু পানি বাহিত রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। আমাদের দেশে পানযোগ্য পানির প্রধান উৎস নদী-খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর ও জলাশয়। এক সময় এ দেশে ১ হাজারের বেশি নদী থাকলেও সেগুলোর বেশিরভাগই এখন মরে গেছে। ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে ফলে পানি ব্যবহারের মাত্রা বাড়ছে । কৃষিকাজে পানি ছাড়া ফসল ফলানোর উপায় নেই ।

এনভায়রমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে নতুন করে আরো প্রায় ৪৮ কোটি ৬০লাখ মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়বে। ওয়াসার ২০০৩ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকা শহরের ৮৪ ভাগ পানি সরবরাহ হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে এবং বাকি ১৬ ভাগ আসে নদী থেকে। আতঙ্কের কথা হল ঢাকার অভ্যন্তর ও চারিপাশ দিয়ে যে খাল-বিল নদী-নালা জালিকার মতো প্রবাহিত হতো তা সমূলে গত ৪০ বছরে একের এক দখল, স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে ভরাট করে চিহ্নমাত্র মুছে ফেলা হচ্ছে। ফলে নানাভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অব্যহত আছে এবং তা ক্রমশই বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৮ সালে ডিপ টিউবয়েলের সংখ্যা ছিল ২৩৪ টি, ২০০৭ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০তে। স্বভাবতঃই ভূত্বকের নিচে একটি স্তর ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৬১.১৮ মিটার বা ১৮৬ ফুট নেমে গেছে।

ঢাকা শহরের সমস্ত মাটি কংক্রিটে ঢেকে যাওয়ায় এ আর পানি শোষণ করতে পারে না বা জমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তাই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ঢাকা শহর ভয়াবহ পানি সঙ্কটে পড়বে। এমনিভাবে গ্রামাঞ্চলের দিকে তাকালেও আমরা ভিন্ন এক ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাব। বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সারা পৃথিবীতেই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। একই ব্যাপার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। এই বর্ধিত চাষাবাদের জন্য পানির চাহিদাও বেড়েছে। অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে বিশ্বের শতকরা ৭০ ভাগ পানি ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র সেচের জন্য। ভবিষ্যতে এই চাহিদা আরো বাড়বে বৈকি। সেই সাথে কমবে বিশুদ্ধ ও স্বাদু পানির উৎস। ভবিষ্যত পৃথিবীবাসীর জন্য পানির সঙ্কট মোকাবিলা করাটাই হয়ত হয়ে উঠবে আগামীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বিভিন্ন বছরে দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য – ১৯৯৪: পানিসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের সবার দ্বায়িত্ব ১৯৯৫: নারী ও পানি ১৯৯৬: তৃষ্ণার্ত শহরের জন্য পানি ১৯৯৭: বিশ্বের পানিঃ আসলেই কি যথেষ্ট? ১৯৯৮: ভূগর্ভস্থ পানিঃ এক অদৃশ্য সম্পদ ১৯৯৯: সবাই আমরা ভাটির দেশের অধিবাসী ২০০০: একবিংশ শতাব্দীর জন্য পানি ২০০১: সুস্বাস্থের জন্য পানি ২০০২: উন্নয়নের জন্য পানি ২০০৩: ভবিষ্যতের জন্য পানি ২০০৪: পানি ও দূর্যোগ ২০০৫: জীবনের জন্য পানি ২০০৬: পানি ও জলবায়ু ২০০৭: পানির আকাল নিরসন ২০০৮: পয়নিষ্কাশন ২০০৯: আন্তসীমান্ত পানি ২০১০: সুস্থ বিশ্বের জন্য নিরাপদ পানি ২০১১: নগরের জন্য পানি ২০১২: পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা শহরবাসীর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩৫ সালে বাংলাদেশে শহর বরং গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সমান হয়ে যাবে। কিন্তু দ্রুতগতিতে নগরীতে পানি সমস্যা সমাধান না করলে কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে।

আগে যেখানে দেশে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাচাদ হতো এখন কমে আসছে শুধু মাত্র পানির স্বল্পতার কারণে। চাষাবাদের জন্য আগে পাওয়া যেত ৩ হাজার কিউশেক পানি। এখন সেই হিসাব এসে দাঁড়িয়েছে ৪০৫ কিউশেকে। যে বাংলাদেশে হাজারের মতো নদনদী ছিল তার অবস্থা আজ করুণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ৩১০-এ নেমে আসছে। ভারতের অনমনীয় মনোভাবের কারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। এতে বাংলাদেশ বড় রকমের ক্ষতি ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। ফারাক্কার মাধ্যমে যেমন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গঙ্গা কপোতাক্ষ এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে পানি সবরাহ ও স্যানিটেশন ২০১৫ সাল-উত্তর জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল এজেন্ডায় পরিণত করার আহ্বান জানিয়েছে সরকার প্রধানরা। বিশ্বের ৭০০ কোটির জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বাস এশিয়ায়। কিন্তু ২০৩০ সাল নাগাদ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পানির চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান দাঁড়াবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা।

জাতীয় উন্নয়নে পরিকল্পনায় সমন্বিতভাবে কৃষিতে সেচ ব্যবহার মান্নোয়নে জ্বালানি লক্ষ্যমাত্র অর্জন ও ক্রমবর্ধমান শিল্পে পানির চাহিদা পূরণের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ভূ-গর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। বর্জ্য পানি পরিশোধনের জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন ও হস্তান্তরে বিভিন্ন দেশকে অবশ্যই মেধাস্বত্ব অধিকারের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে এগিয়ে আসতে হবে। নদী হলো প্রকৃতির সৃষ্টি। জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে নদনদী, লাখ লাখ বছর ধরে ক্রমাগত পানির ধারা একই গতিতে চলতে চলতে নদী-মহানদী হয়েছিল।

সভ্যতার মূলে নদী থাকায় নদীকেন্দ্রিক জনবসতি গড়ে উঠেছিল। একদিকে বসতি বাড়ছে অন্যদিকে নদী তার নাব্য হারাচ্ছে। নদীর উৎসমুখ থেকে পাথর-বালু টেনে নিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় স্থলভাগের মাটিও টানে। ফলে তলদেশ ক্রমে ভরাট হয়। ওই ভরাট অবস্থা যত বাড়তে থাকে গভীরের স্রোতধারা ততই কমতে থাকে। বাড়ছে মানুষ বাড়ছে পানির চাহিদা। শুধুম ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ২২০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে।

ওয়াসা তার ৪টি পানি শোধনাগারে প্রায় ৫০০ গভীর নলকূপের সাহায্যে প্রতিদিন সরবরাহ করে ১৮০ কোটি লিটার। প্রতিদিনের ঘাটতি থাকে ৪০ কোটি লিটার। যা দিন দিন বাড়ছে। পানির এ ঘাটতি কমাতে নদীর দূষণমুক্ত রোধ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। দেশের প্রায় ২৩০টি নদীর মধ্যে আনকই স্রোতহীন এবং শীতকালে শুকিয়ে যায়। খননের মধ্যে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্যকোন উপায় নেই। প্রতিবছর দিবস আসলে দিবস পালিত হয় সভা-সেমিনার। তবে দীর্ঘস্থায়ী কাজ না করলে খুব শীঘ্রই কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে এ পানি নিয়ে।

 

 

লেখকঃ সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক। rbabygolpo710@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here