শৌল বৈরাগী :: ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, পোষাক ছিল না (লুঙ্গি ও হাফ প্যান্ট পরিহিত অনেক মুক্তিযোদ্ধার ছবি আমরা দেখতে পাই), বন্ধুক গোলা বারুদ ছিল না, কোথায় কিভাবে যুদ্ধ করতে হবে জানতেন না। তারা শুধু জানতেন যুদ্ধ করতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে হবে (যুদ্ধে মারা যাবে কিনা সে চিন্তা মাথায় ছিল না)। তারা জানতেন যে, যুদ্ধে গেলে তো কিছু মারা যাবেই; তাই বলে কি যুদ্ধ হবে না! পরাজয় মেনে নিব! কিন্তু যারা বেঁচে থাকবে তারা অবশ্যই দেশ স্বাধীন করবে। আর হয়েছেও তাই। অনেকে মারা গেছেন কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে।

২০২০ সালে দেশ আক্রান্ত হলো করোনা নামক ভাইরাস দ্বারা। শুধু আমাদের দেশ নয়; পুরো বিশ্বই আক্রান্ত। প্রতিটি দেশের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্টরা করোনা প্রতিরোধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। নিজে বাঁচবে কি মরবে সে চিন্তা তারা করছেন না। কয়েকদিন যাবৎ ইতালীর এক ডাক্তারের কথা সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। নিশ্চয় সবার নজরে আসছে বিষয়টা। একজন ডাক্তার (ইতালী) যিনি অবসরে গিয়েছিলেন। বয়স ৮০’র কোঠায়। তিনি ইতালীর এ প্রয়োজনীয় সময়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হাসপাতালে আসছেন এবং করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন।

এমন ঘটনা বিভিন্ন দেশে আরো আছে। আর আমাদের দেশের ডাক্তাররা কি করলেন? উনারা মানব সেবার ব্রত নিয়ে জনগণের পয়সায় ডাক্তার হয়ে, সরকারী চাকরী করে করোনার ভয়ে নিজের প্রাণ নিয়ে পালালেন। ডিউটি বন্ধ করে দিলেন, চেম্বার বন্ধ করলেন, মোবাইল বন্ধ করলেন, হয়তো বা গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে আরামে সময় কাটাচ্ছেন। ধুয়ো তুললেন তাদের পিপিই নেই। কেন ঐ ডাক্তারদের তো প্রাইভেট প্রাকটিস করার কথা নয়।

তথাপিও প্রাকটিস করে প্রতিদিন লাখ টাকা আয় করেন, সাথে সরকারী কোষাগার থেকে সাধারণ মানুষের ট্যাক্স এর টাকায় বেতন নেন, আর ১/২ হাজার টাকা দিয়ে কি নিজে একটা পিপিই তৈরী কাতে পারতেন না। অথবা উনারা টেষ্টগুলো থেকে যে পরিমাণ কমিশন পান তা দিয়ে কি একটি পিপিই তৈরী করে নিতে পারতেন না?

অথবা যে ঔষধ কোম্পানগুলো উনাদের টয়লেট পেপার থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় আসবাব পত্র দেন, বিদেশ যাওয়ার টিকেট দেন তাদের নিকট কি একটা পিপিই চাইতে পারতেন না? অথবা উনাদের মধ্যে যদি সামান্য দেশ ও মানব প্রেম থাকত তবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মত কি কিছু ছাড়াই কাজ করতে পারতেন না?

ডাক্তাররা মাঠ ছেড়ে দিলেন। আরে আজ যদি দেশের মানুষ মারা যায় তবে তারা কি করবে? তারা কি আগের মত রোগী পাবে? অথবা ঐ ডাক্তার/গণ পলাতক বা ঘরে থাকা অবস্থায় যদি নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত হয় তবে কেমন হবে??? আমি বলছি না তাদের কারো এ কারনে করোনা হোক। কিন্তু বলা তো যায় না। কারণ এ করোনা তো কাউকে ছাড়ছে না। প্রিন্স চার্লস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কাউকেইতো ছাড়ছে না করোনা। তো ঐ ডাক্তার কি পালিয়ে থেকে রক্ষা পাবেন। নিশ্চয় পাবেন না। ভাগ্য ভালো পৃথিবীর সব দেশে করোনা হয়েছে। তা না হলে এমন যদি কোন দেশ থাকত যেখানে করোনা হয় নাই বা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের সব ডাক্তার (ব্যতিক্রম আছে) তাদের বউ পোলাপানসহ সেখানে চলে যেত!

আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত যে, এই ডাক্তাররা যখন এইম ইন লাইফ রচনা লিখছেন তখন প্রত্যেকেই লিখেছেন যে আমি ডাক্তার হতে চাই। কারন আমার মা চিকিৎসা ছাড়া গ্রামে মারা গেছে, তাই গ্রামের লোকদের চিকিৎসা করাবো, গরীব লোকদের বিনা মূল্যে সেবা দিব, দেশের লোকদের সেবা দিব ইত্যাদি ইত্যাদি। এটাও জানি যে উনারা অন্তর থেকে এ রচনা লিখেন নি। লিখেছেন পরীক্ষায় পাশ করার জন্য – আর করেছেন মূখস্ত, হৃদয়ে ধারন করতে পারেন নি।

তাই, পরিশেষে বলতে চাই, ১৯৭১ এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ, অস্র, গোলাবারুদ, পোশাক ইত্যাদি ছাড়াই জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করেছিলেন এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে হলেও তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। কিন্তু আজ আমাদের শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত, ডাক্তারী পাশ করা ডাক্তারা সেই ছোট ছোট মুক্তি যোদ্ধাদের মত সাহস দেখাতে পারেননি। তারা নিজ জীবনের মায়ার কাছে হেরে গেছেন, হেরে গেছেন মানবতার কাছে, হেরে গেছেন নাইটিঙ্গল এর কাছে। তবে হা ডাক্তারা (কিছু বা অনেকে) যদি নাও আসেন এ যুদ্ধে জয়ী আমরা হবোই। কারণ কিছু ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনিশিয়ানরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি তাদের স্যালুট জানাই।

শৌল বৈরাগী

আর একটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। করোনা যুদ্ধ শেষ হলে যদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের কোন ভাবে ‍পুরষ্কৃত করা হয়, কোন সার্টিফিকেট দেয়া হয়, কোন ইনসেনটিভ দেয়া হয়, তা যেন কোনভাবেই এই সব ফাঁকিবাজ, মানবতাহীন, স্বার্থপর ডাক্তারদের দেয়া না হয়। এখনই যেন দুইটি লিষ্ট তৈরী করে রাখা হয়। তা নাহলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকার মত হবে। আমারা ঘরে-করোনা বাইরে।

 

 

লেখক: সমাজ উন্নয়ন কর্মী। 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here