১৩ বছরেও হয়নি ২টি ইউনিয়নে নির্বাচন! খোরশেদ আলম বাবুল, শরীয়তপুর প্রতিনিধি :: নতুন ভোটার হইছি ২ বছর যাবৎ। জাতীয় পরিচয়পত্র পকেটে নিয়ে ঘুরি কিন্তু ভোট দেয়ার সুযোগ হচ্ছে না। তাছাড়া আমাদের এলাকায় ১৩ বছর যাবত কোন নির্বাচন হয় না। কী সব সীমানা জটিলতার কারণে চেয়ারম্যান মেম্বাররা উচ্চ আদালতে মামলা করে নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে তাও জানি না। এমন কথাই বলে গোসাইরহাট খেঁয়াঘাট থেকে কুচাইপট্টিতে যাত্রীবাহী মোটরবাইক চালক শামিম সিপাই ও খালেক। তারা আরও জানায় কুচাইপট্টি ইউনিয়নের জন সাধারনের একমাত্র চলাচলের মাধ্যম মোটরবাইক। ইউনিয়নে মাত্র ১ কিলোমিটার কার্পেটিং রাস্তা রয়েছে তা শুধু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি পর্যন্ত।

অবশিষ্ট যে রাস্তা আছে তার কিছু অংশ ইটের সোলিং যা জন সাধারণের চলাচলের অনুপযোগী। বর্ষার সময় কাঁচা রাস্তায় পা ফেলা যায় না। এলাকার উন্নয়ন করবে এমন কোন নেতাও পাওয়া যায় না। ২০১১ সালে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। নির্বাচনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যালট পেপার নিয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার পূর্ব মূহুর্তে সংবাদ আসে নির্বাচন স্থগিত। আমাদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা মিলে পাশবর্তী ইউনিয়নের সাথে সীমানা জটিলতা দেখিয়ে মামলা করেছে। অথচ সেই ইউনিয়নে নিয়মিতি নির্বাচন হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ইউনিয়নের কোন উন্নয়ন আশা করছি না। কারণ ইউনিয়নের উন্নয়নের টাকায় চেয়ারম্যান মেম্বারগণ নির্বাচন বন্ধের জন্য মামলা চালায়।

তাদের কথা মতে কুচাইপট্টি ইউনিয়ন ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। গোসাইরহাট খেঁয়া পার হয়ে মাইঝারা বাজারের দিকে যেতে ইটের সোলিং রাস্তা। ভঙ্গুর রাস্তায় ইটের সোলিং করুন দশা। রাস্তার দু’পাশে পাটকাঠি ও পাট লওয়ার কাজে ব্যবহার করছে গৃহস্থরা। মাঝখান দিয়ে ঝুঁকিতে যাত্রী নিয়ে বহন করে মোটরবাইক চালকরা। তাদের মত কষ্ট করে মাইঝারা ও মাদরাসা বাজারে গিয়ে দেখা হয় এলাকার সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে।

মাদরাসা বাজারের চা দোকান থেকে আবুল বাসার গাজী, জালাল আহমেদ, নোয়াব আলী হাওলাদার, ফজলুর রহমান গাজী বলেন, ইউনিয়নের ২৫ হাজার মানুষের প্রত্যেকেই নির্বাচন চায় শুধু চেয়ারম্যান মেম্বার ১৩ জন স্বার্থন্বেশী লোক ছাড়া। তারা নির্বাচন বন্ধ রাখার জন্য উচ্চাদালতে তদ্বির করে। সাধারণ মানুষের পক্ষে যদি কেউ উচ্চাদালতে তদ্বির করে তা হলে নির্বাচনের আদেশ করাই আনতে পারতো।

মাইঝারা বাজারের দর্জী দোকানদার আক্তার হোসেনের দোকানে অবস’ান করে আলাপ হয় নির্বাচন প্রত্যাশী সাধারণ মানুষের সাথে। তখন তারা জানায়, ২০০৩ সালের পরে তাদের ইউনিয়নে কোন ভোট গ্রহন হয় নাই। পাশবর্তী ইউনিয়ন কোদালপুর ইউপি নির্বাচনে বর্তমান গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসির উদ্দিন তার ভাইকে নৌকার মনোনয়ন পাইয়ে দেয়। আর সেখানে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। কুচাইপট্টি ইউনিয়নে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসির উদ্দিন তার শ্বশুর (বর্তমান চেয়ারম্যান) কে মনোনয়ন না দিয়ে পারবে না। দলীয় মনোনয়ন দিলেই ভাই বশির উদ্দিনের মতো শ্বশুর আবুল বাশার মুন্সীর অবস্থা হবে। তখন উপর মহলের নেতাদের কাছে কি জবাব দিবেন ? সেই ভয়ে নির্বাচন না দিতে চেষ্টা করেন উপজেলার চেয়ারম্যানও।

নির্বাচন প্রত্যাশী আওয়ামীলীগ নেতা গোসাইরহাট উপজেলা আওয়ামীলীগ সহ-সভাপতি জহিরুল ইসলাম, আওয়ামীলীগ নেতা সরদার মোস্তাফিজুর রহমান, সেকান্দার সরদারদের সাথে আলাপ হয়। তখন তারা জানায়, চেয়ারম্যান আবুল বাশার মুন্সী ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন বন্ধ রাখছে। নির্বাচন বন্ধ থাকায় এলাকায় কোন উন্নয়ন হচ্ছে না, আইনশৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে, সাধারণ মানুষ গ্রাম্য বিচার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেখানে শতভাগ মানুষ নির্বাচন চায় সেখানে প্রতারণা করছে চেয়ারম্যান। ইউনিয়নের উন্নয়নের টাকায় মামলা চালায় আর সরকারী অনুদানের কোন হিসাব নাই।

কৃষক আলী মিয়া হাওলাদার ও আলী মিয়া গাজী বলেন, নির্বাচনে প্রয়োজন হয় না তাই চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছে গেলে গুরুত্ব পাওয়া যায় না। যদি নির্বাচন হতো আর ভোটের দরকার হতো তাহলে সাধারণ মানুষের খোঁজ খবর রাখতো চেয়ারম্যান মেম্বাররা। তাদের কাছ থেকে আমরা ন্যায় বিচারও পাই না। যত দ্রুত নির্বাচন হবে তত জন সাধারণের উপকার হবে।

জন দূর্ভোগ ইটের সোলিং রাস্তা জুড়ে গৃহিনী নাছিশা বেগম পুত্রবধু ও কন্যাদের নিয়ে পাট লইছে, তখন তারা জানায় চেয়ারম্যান মেম্বারের নির্বাচন কবে হইছে তা জানা নাই। চেয়ারম্যান মেম্বাররা ভোট আইলে ভোটের জন্য আমাদের খবর নিতো। ভোট হয় না আর আমরা চেয়ারম্যান মেম্বারের দেখাও পাই না। আমরাতো তাদের কাছে কোন টাকা চাই না। রাস্তাঘাট মেরামত করলেও চলতো। এই রাস্তায় যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকে চলে। কত যে দূর্ঘটনা ঘটে এ রাস্তায়। ছাগল মারে, মানুষ মারে মোটরসাইকেল আলারা। এ রাস্তাটা ঠিক করলেও চলতো। কিছুই করে না। আমার একমাত্র মেয়েকে পাশের এলাকায় বিয়ে দেই। এখন শুনি আমার মেয়েকে জামাই ভাত খাওয়াবে না। সেই বিচারও চেয়ারম্যান করে দেয় নাই। এখন আদালতে মামলা করছি।

নির্বাচন কেন হচ্ছে না? এ বিষয়ে জানতে কুচাইপট্টি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে জানা যায় বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল বাশার মুন্সী হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব আছেন। দেখা হয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ৬নং ওয়ার্ড মেম্বার আমিরুল হক মাঝির সাথে। তিনি জানায়, ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি মেম্বারের দায়িত্বে আছেন। সীমানা জটিলতার কারণে ২০০৩ সালের পর আর নির্বাচন হয়নি তার ইউনিয়নে। হাই কোর্টের আপিল বিভাগে মামলা করেছি বিচারক নির্বাচন স্থগিত করে আদেশ দিয়েছেন। স্থানীয় নেতা কর্মীদের মুখে শুনি নির্বাচন হবে তবে আমাদের কাছে কোন নির্দেশ আসেনি।

গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১২ জুন উপজেলার কুটাইপট্টি ও আলওয়ালপুর (সাবেক গরীবেরচর) ইউনিয়নে অন্যান্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সাথে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ১১ জুন ভোট গ্রহনের প্রস’তি নিয়ে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলে বিকাল ৪টায় হাই কোর্টের ফ্যাক্স আসে পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত। সেই থেকেই নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। আদালতের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচন সংক্রান্ত কোন তথ্য দিতে পারবে না।

পরবর্তীতে আলওয়ালপুর ইউনিয়ন গিয়ে দেখা যায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। নির্বাচনে অংশ গ্রহন না করতে পেরে ও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পেরে প্রতিবেদকের সামনে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সৌদি প্রবাসী নান্নু মিয়া। ২০০৩ সাল ভোট প্রয়োগের পর থেকে ৯ বছর সৌদি প্রবাসে ছিল। ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে ভোট গ্রহনের আগের দিন তার ছেলে ফোনে তাকে জানায় ভোট হবে না। তার পরে তিনি বাড়ি আসছেন ৫ বছর হতে চলেছে কিন্তু এর মধ্যে কোন ভোট বা নির্বাচনের কথা শুনেন নি। তিনি আরও বলেন নির্বাচন হওয়া অতি জরুরী। নির্বাচন না হওয়ায় ইউনিয়নের উন্নয়ন স্থবির হয়েছে। আমাদের ইউনিয়নের সাথে পার্শবতী চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার নিল কমল ইউনিয়নের সীমানা নিয়ে জটিলতা আছে বলে আমাদের নির্বাচন হয় না। কিন’ নিল কমল ইউনিয়নে ৩বার নির্বাচন হয়েছে। আমাদের নির্বাচনে বাঁধা কোথায়। যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য নির্বাচন স্থগিত করে লুটপাট করছে তারা সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

গরীবেরচর বাজারের স্টুডিও ব্যবসায়ী সবুজ জানায়, ১০ বছর যাবৎ জাতীয় পরিচয় পত্র পেয়েছে তবুও ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়নি তার। তখন মরিচ ব্যবসায়ী আমজাদ কাজী ও সুলতান সরদার বলেন, ভোট দেওয়ার জন্য কবে থেকেই বসে আছি, ভোট তো হয় না তাই ভোটও দিতে পারি না।

গরীবেরচর ইউনিয়নে নির্বাচনের পূর্ব মূহুর্তে নির্বাচন স’গিত ঘোষনা শুনে সব চেয়ে বেশী মর্মাহত হয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কালাম। আবুল কালাম নির্বাচনে অংশ গ্রহন করতে পারলে হয়তো বিজয়ী হতে পারতেন। আক্ষেপ করে চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কালাম বলেন, নির্বাচনের পূর্ব মূহুর্ত ২০১১ সালের ১১ জুন শুনি ১২ জুনের নির্বাচন স্থগিত ঘোষনা করেছে উচ্চ আদালত। তখন আমার বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। আমার তখন মনে হয়েছিল সাধারণ মানুষ আমাকে কত ভালোবাসে। যারা আমার বাড়িতে সমবেদনা জানাতে আসে তারা হয়তো আমাকেই ভোট দিত। সে সকল মানুষের ভোট পেলে আমিই বিজয়ী হতাম। এখনও আমার বিশ্বাস নির্বাচন দিলে আর জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে আমিই বিজয়ী হবো। গবীবের চরের শতভাগ মানুষ নির্বাচনের পক্ষে শুধু চেয়ারম্যান মেম্বাররা ছাড়া। শুধুমাত্র কয়েকজন মানুষের স্বার্থ হাসিলের জন্য সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলছে। এটা আইনের আওতায় আনা উচিৎ।

কুচাইপট্টি ইউনিয়নের ২০১১ এর ১২ জুনের নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মোঃ নাছির উদ্দিন স্বপন বলেন, ২০১১ এর ১২ জুন নির্বাচনে আমি চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলাম। পাশ্ববর্তী নিলকমল ইউনিয়নের সাথে সীমানা জটিলতা দেখিয়ে ২০১১ এর ৩ মে চেয়ারম্যান আবুল বাসার মুন্সী হাই কোর্টে ডাব্লুপি-৩১৬৪/১১ রিট মামলা দায়ের করে। হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্বাচনের পূর্ব মূহুর্ত ১১ জুন ৩ মাসের জন্য নির্বাচন স’গিতাদেশ প্রদান করে। সেই থেকে নির্বাচন বন্ধ। পরবর্তীতে আমি চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে চেম্বার জজ আদালতে আপিল ৪১৫/১১ মামলা দায়ের করি। সেই পেক্ষিতে বিগত ২ আগষ্ট মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি এএনএম বশিরুল্লাহ এবং বিচারপতি ফারাহ্‌ মাহাবুব এর বেঞ্জ আবুল বাসার মুন্সীর রিট আবেদন খারিজ করেন। তার পর থেকে নির্বাচনে আর বাঁধা নাই। কোন অদৃশ্য শক্তি নির্বাচন হতে দিচ্ছে না। খুব শীঘ্রই নির্বাচন চাই। এলাকার শতভাগ মানুষ নির্বাচনের পক্ষে।

আলওয়ালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বেপারী অনুকুলে পাল উড়িয়ে স্রোতের ছন্দে বলেন, সীমানা বিরোধ সংক্রান্ত হাই কোর্টে রিট আবেদন ছিল। কোর্ট ৩ মাসের মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তি করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ করে। আজও বিরোধ নিস্পত্তি হয় নি তাই নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচন কবে হবে তা আদালত ও নির্বাচন কমিশন জানে।

গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাচন অফিসার শেখ বদরুদ্দিন বলেন, নির্বাচনের পূর্ব মুহুর্তে হাই কোর্টের নির্দেশে নির্বাচন বন্ধ করি। পরবর্তীতে নির্বাচন হওয়ার কোন নির্দেশ পাইনি। তবে পূর্ববর্তী শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ইউএনও ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়ে সীমানা জটিলতা নিরশনে বৈঠক করেছে। তারও কোন সুফল পাচ্ছি না। নির্বাচন কবে হবে তাও জানতে পারিনি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here