ঢাকা : রাজনৈতিক সহিংসতা, অবরোধ ও হরতালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের পরিবহন খাত। আয়-উপার্জনহীন ৩৫ লাখ পরিবহন শ্রমিকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি গাড়ি বন্ধ থাকায় লোকসানে পর্যুদস্থ পরিবহন মালিকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। নভেম্বরে ১০ দিনের হরতাল ও গতকালসহ চার দিনের অবরোধে পরিবহন খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ বছর ১১ মাসে ৫০ দিনের হরতাল ও চার দিনের অবরোধে প্রাণ গেছে ৩১ পরিবহন শ্রমিকের। অগি্নসংযোগ ও ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার যানবাহন। মালিক ও শ্রমিকরা অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিবহন ব্যবসা এখন মারাত্দক ঝুঁকিতে পড়েছে। গাড়ি বন্ধ থাকায় পরিবহন মালিকরা ব্যাংকের ঋণ ও কিস্তির টাকা দিতে পারছেন না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাব মতে, চলতি বছর রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল-অবরোধে ৩১ জন পরিবহন শ্রমিকের জীবন গেছে। এর ফলে উপার্জনক্ষম নির্ভরতার মানুষটি হারিয়ে ৩১টি পরিবার দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। পাশাপাশি এই সেক্টরের ৩৫ লাখ শ্রমিকও সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধে অমানবিক জীবন-যাপন করছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে যানবাহন বন্ধ থাকায় লাখ লাখ পরিবহন শ্রমিক তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টকর জীবন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরা। হরতাল-অবরোধে অভ্যন্তরীণ রুটের যানবাহনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রুটের যানবাহনও বন্ধ থাকছে দিনের পর দিন। ঢাকা থেকে কলকাতা, আগরতলা ও শিলিগুড়ি রুটের বাস পরিচালনাকারী শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, হরতালে যানবাহন ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে আমাদের মালিকদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা এর বিচার চাইব কার কাছে। তিনি বলেন, আমরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামিয়েছি। সেই গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হলে আমাদের ঋণ শোধ করার কোনো উপায় থাকবে না।

আগুন-ভাঙচুরের শিকার আড়াই হাজার গাড়ি : পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড ও পরিবহন সমিতিগুলোর হিসাব অনুযায়ী এ বছর ৫৪ দিনের কর্মসূচির সময় প্রায় আড়াই হাজার যানবাহন পোড়ানো ও ভাঙচুর করা হয়েছে। মালিকদের উপার্জন বন্ধসহ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, নভেম্বরেই আমাদের সমিতিভুক্ত সদস্যদের দুই শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধে পরিবহন মালিকরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই ব্যাংক ঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না। তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

১৬ হাজারের ট্রাক ভাড়া এখন ৪৫ হাজার : বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হরতাল-অবরোধে এ পর্যন্ত আমাদের ৩০০ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, মিনিট্রাক ও পিকআপ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মালিকরা নিরাপত্তার অভাবে রাস্তায় গাড়ি নামাতে চান না। ফলে আগে যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ১৫-১৬ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া ছিল এখন সেখানে গতকাল ট্রাক ভাড়া উঠেছে ৪৫-৫০ হাজার টাকায়। তারপরও পণ্যবাহী ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। তৈরি পোশাকের শিপমেন্ট মৌসুম হওয়ায় রাস্তায় গাড়ি বের না করেও উপায় নেই। গতকাল সকালে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালে সমিতির কার্যালয়ে সভাপতি হাজী তোফাজ্জল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় পরিবহন সেক্টরকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সভায় ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবিও জানানো হয়।

যোগাযোগ খাতে সরকারের ক্ষতি ৪২ কোটি টাকা : গত কয়েক মাসে হরতাল-অবরোধে শুধু যোগাযোগ খাতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৪২ কোটি টাকা। গতকাল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন। গাড়ি পোড়ানো ও রাজস্ব খাতে এ ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান। ওবায়দুল কাদের জানান, গত কয়েক মাসে বিআরটিসির ৬টি এসি বাস, ৩টি আর্টিকুলেটেড বাস, ৭৪টি সিএনজিচালিত একতলা বাস, ৭০টি টিসি/টাটাসহ ১৫৩টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৩২টি বাস। এর মধ্যে রয়েছে ১১টি ডাবল ডেকার বাস, ১টি আর্টিকুলেটেড বাস, ৯টি সিএনজি একতলা বাস, ১১টি টিসি/টাটা। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭ কোটি টাকা। হরতাল ও অবরোধে যোগাযোগ খাতে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় সাড়ে ২৯ কোটি টাকা। ভাঙচুর ও পোড়ানোর কারণে মোট ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে বেশকিছু বেইলি সেতু, বিভিন্ন স্পটে বিটুমিনাস পেভমেন্ট নষ্টের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক গাছ কাটা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here