সয়াবিনজহিরুল ইসলাম শিবলু, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: সয়াবিনের রাজধানী হিসেবে খ্যাত উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। অনুকূল আবহাওয়া ও উর্বর মাটির কারণে এ অঞ্চলে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত প্রায় ৮০ ভাগ সয়াবিন লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত হয়। আর এবার সয়াবিনের রাজধানী খ্যাত লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন চাষে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।

জেলার কৃষকদের কাছে সয়াবিন শস্যটি ‘সোনা’ হিসাবে পরিচিত। এখন রবি মৌসুম। এ মৌসমে সয়াবিন আবাদ হয়। তাই সোনা ফলাতে বিস্তির্ণ মাঠজুড়ে বীজ বুনেছে কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি লক্ষ্মীপুর অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলার ৫ উপজেলায় ৪৮ হাজার ৫১৭ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৪৮হাজার ৭১৭ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ করা হয়েছে।

এর মধ্যে জেলার রামগতি উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর, কমলনগর উপজেলায় ১৭ হাজার ৯০০ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৭ হাজার ৮৫ হেক্টর, রায়পুর উপজেলায় ৬ হাজার ২১০ হেক্টর ও রামগঞ্জ উপজেলায় ৭২ হেক্টর জমি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৩০১ মেট্রিক টন সয়াবিন। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার সয়াবিন উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা। এখানে উৎপাদিত সয়াবিনের অধিকাংশ দিয়ে পোল্ট্রি খাদ্য তৈরী করা হয়।

সয়াবিন তেল জাতীয় শস্য। গাছ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। গাছের কান্ডে ফুল হয়। ফুল থেকে শিমের মত চড়াতে বীজ জন্মে, এই বীজগুলোকেই সয়াবিন বলা হয়। সয়াবিন ভোজ্য তেলের প্রধান উৎস। এটি অত্যান্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। কচি ও শুকনো সয়াবিন বীজ সবজি ও ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। পরিণত সয়াবিন বীজ থেকে শিশুখাদ্য, সয়া দুধ, দই ও পনির, বিস্কুট ও কেকসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার তৈরি হয়ে থাকে। এছাড়াও পোল্ট্রি ও ফিসফিড তৈরি, রং, সাবান এবং প্লাস্টিক মুদ্রণের কালি ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সয়াবিন একটি অপরিহার্য উপাদান।

জেলার রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও সদর উপজেলায় আমন ধান কাটার পরই কৃষকরা সয়াবিন আবাদের প্রস্তুতি নেন। জমিতে রস থাকতে থাকতে চাষ দেন। আইল কেটে নেন, জমির উঁচু-নিচু সমান করেন। আগাচা পরিষ্কার, জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। জমি শুকালে মই দিয়ে মাটি ঝরঝরে করা হয়। এই সব প্রস্তুতি শেষে বীজ বুনেন কৃষকরা। ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে শুরু করে চলতি মৌসুমে সয়াবিনের বীজ বুনা শেষ হয়েছে। কৃষকরা সারিতে আথবা ছিটিয়েও সয়াবিনের আবাদ করে থাকেন। বর্তমানে বীজ থেকে চারা উঠতে শুরু হয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, সয়াবিন চাষে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয়। চাষাবাদ পদ্ধতি সহজ। সয়াবিনে ধানের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। বিক্রি করলে আর্থিকভাবে লাভবান হয় কৃষকরা। যে কারণে কৃষকরা সয়াবিন চাষে বেশি আগ্রহী।

কমলনগর উপজেলার সয়াবিন চাষি মো. হারুণ, ইসমাইল হোসেন, খোকন মিয়া জানান, তারা সরকারী ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিয়ে সয়াবিন চাষ করেছেন। এবার মাঠে আগাছা ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ কম। এছাড়া অনুকূল আবহাওয়া ও সঠিক সময়ে বীজ বপন করতে পারায় ভাল চারা গজিয়েছে। তাই বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা। তবে স’ানীয়ভাবে সয়াবিন ভিত্তিক কারখানা গড়ে তোলা ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রন করার জন্য তারা সরকারের প্রতি দাবি জানান।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সয়াবিন বছরের সব সময় চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে ফলন বেশি হয়। যে কারণে রবি মৌসুমে সয়াবিনের আবাদ হয়ে থাকে। ৯৫ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.৫ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়ে থাকে। সয়াবিনের পাতাসহ অন্যান্য অংশ এবং শিকড় অল্প সময়ের মধ্যে পচে-গলে মাটিতে জৈব সার তৈরি করে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অনেক উন্নত হয়। মাটি হয় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সয়াবিন চাষের ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পরবর্তী ফসলে সারের ব্যবহার অর্ধেক নেমে আসে। উৎপাদন খরচ কমে যায়। ফলনও ভালো হয়।

লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হবে। ভালো ফলন পেতে কৃষি অফিস ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে গিয়ে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে জেলায় সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র বা সয়াবিনের ভিত্তিক কল-কারখানা না থাকায় চাষিরা সয়াবিনের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখানে সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পেতেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here