দেলোয়ার জাহিদ, কানাডা থেকে ::

বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকদের গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হওয়া উচিত। দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় ব্যালটে সমান অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। ভোটাধিকার বঞ্চনা অসাংবিধানিক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ এক সময় বিদেশী দেশগুলোর কাছে অবহেলিত ছিল। তাঁর সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মঞ্চে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।(বাসস, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী  এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, স্বচ্ছ্বতা জবাবদিহিতায় বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও এগিয়ে। (বাসস, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ২৮ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮৪ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা সেলিম ও দেলোয়ার স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন।…১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকচক্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে দেশে আবারো গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে। উত্থান ঘটে স্বৈরশাসনের।… শহীদ ছাত্রনেতা সেলিম ও দেলোয়ারের ৩৯তম শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে আজ এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সকলকে সচেষ্ট থাকার আহবান জানিয়ে এসকল মন্তব্য করেন (সূত্র বাসস) ভাষা ও ভোটাধিকারের জন্যও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ভিত্তিমূল।

স্বতীর্থ তোফায়েল আহমেদ প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে সম্প্রতি একটি নিবন্ধ লিখেছেন এর উপসংহারে এনআরবি ও প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ চাওয়া হয়েছে। তার মতে,  মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ১ কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী পৃথিবীর নানা দেশে কর্ম্মরত। তা ছাড়াও এদেশের অনেক নাগরিক বিভিন্ন কারণে বিদেশে অবস্থান করেন কিংবা দ্বৈত নাগরিক হিসেবে দেশের বাইরে থাকেন। নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থাপনাগত সীমাবদ্ধতায় তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।  এভাবে তাদের ভোটের বাইরে রাখা  সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন করার সামিল।

প্রবাসীদের তাদের জন্মের দেশে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার একজন প্রবাসীর দেশের আইনের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। কিছু দেশ (যেমন ফ্রান্স) তাদের প্রবাসী নাগরিকদের সীমাহীন ভোটদানের অধিকার দেয়, যা তাদের নিজ দেশে বসবাসকারী নাগরিকদের অনুরূপ। অন্যান্য দেশ প্রবাসী নাগরিকদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বছরের জন্য ভোট দেওয়ার অনুমতি দেয়, তারপরে তারা আর ভোট দেওয়ার যোগ্য থাকে না (যেমন জার্মানির জন্য ২৫ বছর)। অন্যান্য দেশগুলো শুধুমাত্র সেই দেশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য ভোটের অধিকার সংরক্ষণ করে, যার ফলে প্রবাসী নাগরিকরা তাদের নিজ দেশ ছেড়ে চলে গেলে (যেমন আয়ারল্যান্ড, অত্যন্ত সীমিত ব্যতিক্রম সহ) তাদের ভোটাধিকার থেকে ছিনিয়ে নেয়।…স্থানীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার কখনও কখনও স্বতন্ত্র দেশগুলোর মধ্যে পরিবর্তিত হয়, সাধারণত ফেডারেল ব্যবস্থায়, যেমন সুইজারল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট ক্যান্টন থেকে আসা সুইস প্রবাসীরা ক্যান্টন পর্যায়ে নির্বাচনে ভোট দিতে পারে, অন্য ক্যান্টন থেকে আসারা পারে না । সমস্যাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলি দ্বারা উত্থাপিত হয়েছে, বিশেষ করে একটি ইইউ রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের অন্য একটি রাজ্যের নাগরিকদের ক্ষেত্রে। ২০০৬  সালের হিসাবে, ৯৩টি দেশ তাদের প্রবাসী নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে: ২১টি আফ্রিকান দেশ, ১৩টি আমেরিকার দেশ, ১৫টি এশিয়ান দেশ, ৬টি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ এবং ৩৬টি ইউরোপীয় দেশ। ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি বিস্তৃত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা অনুসারে, গবেষণাধিন ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ১১৫টিতে বহিরাগত ভোট দেওয়ার বিধান ছিল (তথ্য সূত্র উইকিপিডিয়া)

কানাডিয়ান নাগরিক যারা বিদেশে বসবাস করেন তারা ভোট দেওয়ার যোগ্য যদি নির্বাচনের দিনে তাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হয় এবং এর আগে তারা কানাডায় বসবাস করেন, তারা শেষ কবে দেশে বসবাস করেছেন তা নির্বিশেষে। ভোট দেওয়ার জন্য, বিদেশে বসবাসকারী নির্বাচকদের অবশ্যই ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার অফ ইলেক্টরে নিবন্ধিত হতে হবে। এটি করার জন্য, তাদের অবশ্যই তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করে এমন নথি সরবরাহ করতে হবে। যারা নিবন্ধিত নন তারা অনলাইনে আবেদন করতে পারেন বা একটি আবেদনপত্র প্রিন্ট করে ইলেকশনস কানাডা মেইল ও ফ্যাক্স পাঠাতে পারেন। তারা ডাকযোগে ফর্মের একটি মুদ্রিত অনুলিপি পেতে ইলেকশন কানাডার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। যারা নিশ্চিত নন তারা নিবন্ধিত কিনা তারা ইলেকশন কানাডায় ফোন করে চেক করতে পারেন।…বিদেশে বসবাসরত কানাডিয়ানদের দেওয়া ভোট নির্বাচনী জেলায় গণনা করা হয় যেখানে তারা কানাডা ছাড়ার আগে শেষবার বসবাস করেছিল।

কানাডার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ আন্তর্জাতিকভাবে বিদেশে বসবাসকারী কানাডিয়ানদের ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইলেকশনস কানাডার তথ্য অনুসারে, প্রায় ৩৬,০০০ কানাডিয়ান বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভোটারদের রেজিস্টারে বিদেশে বসবাস করছেন এবং তারা এই ফেডারেল নির্বাচনে তাদের ব্যালট দিতে পারেন। সংস্থাটি বলেছে যে কানাডার সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে রায় দেওয়ার পরে ভোট দিতে ইচ্ছুক প্রবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে যে পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ধরে বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। আইনি সিদ্ধান্তের অর্থ হল সমস্ত যোগ্য কানাডিয়ান, তারা যত বছর বিদেশে বাস করুক না কেন, একটি ব্যালট দিতে পারবে।
(সূত্র সিবিসি নিউজ সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২১ )

বাংলাদেশের সক্ষমতার কথা এখন বিশ্বজনীন, অক্ষমতা নয় বরং সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলোতে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যমত ও যুগোপযোগী সিদ্বান্ত গ্রহণ। প্রথমআলো সূত্রে জানা গেছে, দ্বৈত নাগরিকত্ব: আরও ৪৪ দেশের নাগরিকত্ব নিতে পারবেন বাংলাদেশিরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আজ সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‌এ–সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশিদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আরও ৪৪ দেশের নাগরিক হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকত্বও অব্যাহত রাখা যাবে। বর্তমানে আমেরিকা ও ইউরোপের ৫৭টি দেশের নাগরিক হলে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ পান বাংলাদেশিরা। সরকারের এ সিদ্বান্ত নি:সন্দেহে প্রবাস বান্ধবতার পরিচায়ক এবং ধ্যন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রগতি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের  উপর নির্ভর করে এমন অনেকগুলো খাতের মধ্যে এটি একটি অন্যতম খাত । সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে ১২ কোটির বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে। তারা শ্রম, ঘাম দিয়ে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠায়। বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণার পর, পাকিস্তানের অবস্থাও  সংকটাপূর্ণ,  বিশ্বব্যাপী দেউলিয়া আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যখন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে , তাতে প্রবাসীদের  রেমিট্যান্স দেশকে আশার আলো দেখাচ্ছে।

সে আশার আলো দেখানো বাংলাদেশের ১২ কোটি প্রবাসী নাগরিকদের গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকার প্রদান এখন সময়ের দাবি।  স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে এর কোনো বিকল্প নেই.. বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানকে স্বীকৃতি প্রদান, হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতা দূর সহ প্রবাসী বান্দব একটি বৈদেশিক প্রশাসন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে , ১২ কোটি প্রবাসী নাগরিকের ১২ কোটি পরিবার বাংলাদেশের ভোট ব্যবস্থায় নিশ্চয় একটি  প্রবাসী বান্ধব সরকারই  আশা করবে।

[লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী]  

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here