দেলোয়ার  জাহিদ, আলবার্টা, কানাডা খেকে ::

১৮ কোটি মানুষ এর উচ্ছ্বসিত অপেক্ষায় থাকা  এক বিস্ময়কর  চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ নির্মাণ করেছে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বপ্ন সাধ এর সে পদ্মা-সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করে অসম্ভবকে  সম্ভব করে তুলেছেন।  “সর্বদা,” ফিলিপ লারকিন লিখেছেন, “একটি সেতুর দ্বারাই আমরা বাস করি।” সেতুগুলি আমাদের সংযোগের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে, বিভাজন জুড়ে ওঠার জন্য এবং এটি আকাঙ্খাগুলির অসমাপ্ত কাজ যা সেতুগুলির মাঝে এমন আলোড়ন সৃষ্টি করে, বিশেষ করে যখন তারা চতুরতার ধারণায় হয় বিস্ময়কর। ফিলিপ পৌরাণিক কাহিনী, কুসংস্কার, সাহিত্যিক এবং আদর্শিক চিত্রের পাশাপাশি স্থাপত্য এবং বাদ্যযন্ত্রের চিত্রের একটি সমৃদ্ধ সংকলন তৈরি করেছিলেন, অফ ব্রিজস নয়টি বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টারে, সেতুগুলির একটি কাব্যিক এবং দার্শনিক ইতিহাসকে সংগঠিত করেছিলেন । আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন সময় এবং স্থানগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট গদ্যে লাফিয়ে, টমাস হ্যারিসন মানব সেতুগুলির বিভিন্ন অর্থ এবং ভ্যালেন্সের একটি প্যানোরামিক বিবরণ দিয়েছেন, প্রশ্ন করেছেন কেন সেগুলি তৈরি করা হয়েছে এবং তারা এগুলোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিশ্বায়িত বিশ্বের মেগা-সেতু হিসাবে সেতুগুলির পর্যালোচনায় দেখা যায় পদ্মা-সেতু আবেগপূর্ণ সে সংযোগগুলোর মাঝে নিজের একটি অবস্থান করে নিতে যাচ্ছে।  

বিশ্বের দীর্ঘতম ১০ সেতু নিয়ে বিবিসি এর টমাস লিং একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন- ১. দানিয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (১৬৪ কিমি), ২. চাংহুয়া-কাওশিউং ভায়াডাক্ট, তাইওয়ান (১৫৭ কিমি, ৩. ক্যাংডে গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (১১৬ কিমি), ৪. তিয়ানজিন গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (১১৩ কিমি), ৫. ওয়েনান ওয়েইহে গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (৭৯ কিমি) ৬. ব্যাং না এক্সপ্রেসওয়ে, থাইল্যান্ড (৫৪ কিমি) ৭. বেইজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (৪৮ কিমি) 8. লেক Pontchartrain Causeway, USA ৩৮ কিমি ৯. উহান মেট্রো ব্রিজ, চীন ৩৭ কিমি ১০. মানচাক সোয়াম্প ব্রিজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৩৬ কিমি).

বাংলাদেশের পদ্মা সেতু হল পদ্মা নদীর উপর একটি বহুমুখী সড়ক-রেল সেতু । যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু এবং সড়ক চলাচলের জন্য প্রথম নির্দিষ্ট নদী পারাপারের মাধ্যম । এটি লৌহজং, মুন্সীগঞ্জকে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের সাথে সংযুক্ত করছে, এছাড়াও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাথে তা সংযুক্ত করবে। বাংলাদেশের স্বপ্নীল ও আবেগপূর্ণ  এ পদ্মা-সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি.

পদ্মা তীরের মানুষ আনন্দে আত্মহারা সেতু উদ্বোধনের কাউন্ট ডাউনের দিনটি থেকে শুরু করে এ  পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হয়েছে কাজের পরিধি ও পরিসর। মাওয়ার আশেপাশে তৈরি হচ্ছে নতুন করে নগরায়ন, দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী সহ হাজার হাজার শ্রমিক কর্মীদের পদচারণায় প্রকম্পিত হচ্ছে জনপদ ।স্বপ্নের এ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা আর সেতুর নিচতলার রেললাইন ঘিরে রাজধানী ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত চলমান রেল লিঙ্ক প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাস   (২৪ মে ২০২২) শিরোনামে ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে প্রকাশ, “বিশ্বব্যাংক টালবাহানা করে অর্থ প্রদানে সরে দাঁড়ালে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় নিজস্ব অর্থায়নে মূল নির্মাণ শুরু হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর।

লৌহজংয়ের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই ভালো লাগা ভাষায় বোঝাতে পারবো না। বহু প্রতীক্ষিত সেতু খুলে দেওয়ার দিন তারিখ হয়েছে, এই সংবাদটি আমাদের জন্য বিশেষ করে পদ্মা পাড়ের মানুষের জন্য গৌরবের।—মাওয়ার স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর মিয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন-তারিখ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে দেশ পদ্মা সেতুর যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।’—মেদিনীমণ্ডল গ্রামের আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর মধ্যদিয়ে পুরো অঞ্চলের চেহারা বদলে যেতে শুরু করেছে। অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। আর সেতুর কাজ শুরু থেকে ২০১৫ শেষ দিকের সঙ্গে ২০২২ সাল তুলনা বিস্ময়কর। চিন্তা করা যায় না কত বেশি বদলে গেছে সেতুর দুই পাড়।’—
কুমারভোগ চাঁন্দের বাড়িতে ১/২টি দোকান ছিল। সেখানে এখন বহুতল মার্কেট। বিপণী বিতান, ব্যাংক-বীমাসহ শত শত দোকান। মুন্সীগঞ্জের লৗহজং ও শ্রীনগর পাশাপাশি দুইটি উপজেলায় ও শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচর এই চার উপজেলায় বড় রকমের পরিবর্তন স্পষ্ট। সব খানেই পদ্মা সেতুর জৌলুশ।”

সংবাদ (২৪ মে ২০২২) এক প্রতিবেদনে সেতু বিভাগের বরাত দিয়ে জানায়, সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ চলছে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হচ্ছে। দুটি ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি থাকবে। এর পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে উদ্বোধনী ফলক।

বাংলাদেশ দীর্ঘ সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ এক পথ ধরে বেশ কয়েকটি মাইলফলক অতিক্রম করেছে এবং  গৌরব ও গর্বের সাথে স্মরণীয় এক উদযাপনের মাধ্যমে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময়ে পা দিয়েছে।  উচ্চ প্রবৃদ্ধির সাথে দেশটিতে  তার মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ৩টি মানদণ্ড পূরণ করায় বাংলাদেশকে এলডিসি বিভাগ থেকে স্নাতক হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে ও সহায়তা করেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্যে ও কাজ করছে। সামনে আরো অনেক কিছু অর্জনের পথকে খুলে দিয়েছে  পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ তার ৫০ তম জন্মদিন , গৌরব ও গর্বের সাথে উদযাপন করেছে ২৫ জুন স্মরণীয় আরেক উদযাপনে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে তা এক মাইল ফলক হয়ে থাকবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে জড়িত প্রত্যেকেরই একটি মহান “ধন্যবাদ” প্রাপ্য ৷ ব্রিজের এ গ্রান্ড উদ্বোধন একটি ঐতিহাসিক বিষয়, দেশবাসী  আনন্দিত যে এত মানুষ এটি উদযাপন করতে এবং ইতিহাসের অংশ হতে চলেছেন ৷ এ দিনের স্মৃতিগুলো নতুন শহরের যাদুঘরে কোনও এক সময়ে প্রদর্শিত হবে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য দেখা, কথা বলা হবে. যদিও পদ্মা সেতু আমাদের ভবিষ্যতের সেতু, যাদুঘরটি হবে আমাদের অতীতের সেতু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল স্বপ্ন দেখা এবং সৃজনশীল হওয়া। নতুন এ পদ্মা সেতু বিস্ময়কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার  একটি সফল রূপান্তর । চিরস্মরণীয় হোক পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন।

[লেখক : সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা, কানাডা ) নিবাসী]

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here