তাহমিনা শিল্পীতাহমিনা শিল্পী :: ভোরের আবসা আলো ফুটতেই পৌঁছে গেলাম নদীর ঘাটে।
সেখানে একটি মাত্র নৌকা বাঁধা। মাঝি আমার হাত ধরে নৌকায় তুললো। জল থৈ থৈ নদী। ঠিক আমার ছোটবেলায় কুমার নদকে যেমনটা দেখেছিলাম।

আমি নৌকার সামনের দিকটায় ছঁইয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখতে লাগলাম। স্নিগ্ধ ফুরফুরে বাতাস। গ্রামের বৌয়েরা লম্বা ঘোমটা টেনে কলসি কাখে দল বেঁধে আসছে নদী থেকে  জল ভরতে।বক,গাঙচিল আর ফিঙে উড়ে বেড়াচ্ছে।হঠ্যাৎ হঠ্যাৎ ঝুপ্‌ করে ঠোঁঠ দিয়ে মাছ তুলে নিচ্ছে নদীর জল থেকে।জেলেরা মাছ ধরার ভেসাল টেনে তুলছে। গোয়ালা ঝাঁকা দুলিয়ে নদীর পানিতে গরুকে খাওয়ানোর জন্য ঘাস পরিষ্কার করছে।

কুসুমিত সূর্যটা তখনই উঁকি দিয়ে জেগে উঠলো নদীর বুক চিড়ে।মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম।

– আমরা কোথায় যাচ্ছি?

– বলা বারন আছে।

– বারন আছে! কে বারন করেছে?

-ওই যে দুরে গ্রামটা দেখতে পাচ্ছেন।সেখানে নদীর পাড় ঘেসে আছে একটি ছোট্ট মাটির ঘর।ওখানে গেলেই তার দেখা পাবেন।

আমি অবাক বিস্ময়ে সেই গাঁয়ে পৌঁছাবার অপেক্ষায় রইলাম।

মাঝি গম্ভীর মুখে নদীর জলে বৈঠা ফেলছে ছলাৎ ছলাৎ।

ক্ষানিকবাদে গিয়ে নৌকা ভিড়ল সেই গাঁয়ের ঘাটে।মাঝি বলল-

-আমার দায়িত্ব আপাতত শেষ। আর হ্যাঁ,আপনাকে নিজের গাঁয়ে আবার পৌঁছে দিয়ে আসার দায়িত্ব তিনি আমাকেই দিয়েছেন। এবার আপনি যান। কাজ শেষ করে আসেন। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।

কিছুটা দ্বিধা,কিছুটা ভয় নিয়ে আমি নৌকা থেকে নামলাম। একবার ভাবলাম ফিরে যাই। কিন্তু কৌতুহল আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলল বিস্ময় গাঁয়ের দিকে।

মিষ্টি কিন্তু অদ্ভুত একটা আলোক রশ্মি আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে কিছুদূর এগিয়ে আমি পৌঁছলাম সেই গাঁয়ে। সেখানকার আকাশে যেন কেউ আবীর ছড়িয়ে রেখেছে। ক্ষানিকবাদে বাদে বাদে বদলাচ্ছে আকাশের রঙ। কখনও নীল,কখনও গোলাপী,কখনও খয়েরী,কখনও আবার কয়েকটি রঙের খেলা। ঠিক যেন স্বপ্নের মত। চারিদিকে সবুজময়। গাছেগাছে পাখির কলতান। ফসলে ভরা দিগন্ত জোড়া ক্ষেত। ফুলে-ফলে সুবাসে ভরা বাগান।

আমি যতই এগুচ্ছি আলোর রোশনাই ততই যেন বাড়ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে আমার মুগ্ধতা ও কৌতুহল। হঠ্যৎ আমার ডানদিক থেকে সুশীতল সতেজ বাতাস ঢেই খেলে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতেই চোখে পড়ল একটি ছোট্ট মাটির ঘর।সেই ঘর থেকে চারিদিকে শান্ত-শুভ্র আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরো গাঁ। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা সুর। বুঝতে পারলাম আমি গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরটির দূয়ারে দাঁড়ালাম।

হাসিমুখে তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। ছোটছোট কালো মসৃন চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পরনে ধবধবে সাদা পোশাক।শ্যামলা মুখটা দেখতে ভীষন পবিত্র আর সরল। চোখে আত্মবিশ্বাসের একটা কোমল দ্যুতির ঝলক।আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন।

-কেমন আছো মা?

-ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?

-এখানে সবাই সবসময় ভালো থাকে।

-আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না।

-আমরা কি নিজেকেই চিনতে পারি মা?

এরপর তিনি দরদমাখা মোলায়েম কন্ঠে আমাকে বললেন।

স্বাধীনতা দিবসের ছোটগল্প।-আমি কেউ না।তবে এই আলোকিত গাঁয়ের লোকেরা আমাকে তাদের প্রধান বলে মানে।তোমাকে কিছু কথা বলি মন দিয়ে শোন।আমাদের এই গাঁয়ে কেউ একা ভালো থাকে না।সবাই মিলেমিশে একসাথে থাকে। সবাই মিলেই ভালো থাকে।এখানে কোন দলাদলি নেই।কারো সাথে কারে কোন বিরোধ নেই। কোন সম্পদ কারো একারও নয়।কেউ নিজের স্বার্থ দেখে না,নিজেকে নিয়ে ভাবেও না।কিন্তু তোমার গাঁয়ে এখন ঘোর অন্ধকার।সেখানে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যায়,অবিচার আর অরাজকতায় নিমজ্জিত।প্রতিনিয়ত নিহত হচ্ছে মানবতা।তবে আমরা শুধু নিজেরাই ভালো থাকতে চাই না। বরং আশেপাশের গাঁয়ে যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে চাই।

-কিন্তু আমাকে কেন এখানে ডাকা হল বুঝতে পারছি না।

-আমরা জানি তুমি তোমার গাঁয়ের এমন ক্রান্তিকাল নিয়ে ভাবো। তুমি মনেমনে তোমার গাঁয়ের লোকের পরিত্রানের উপায় খোঁজো ।তাই তোমাকে আমরা আলোর দূত হিসেবে এখানে ডেকে এনেছি।

-আমাকে কি করতে হবে?

কিছু না বলেই তিনি ঘরের ভিতরে ফিরে গেলেন।আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।একটু পরে এক আজলা আলো হাতে ফিরে এলেন।তারপর আমার হাতে আলো তুলে দিয়ে বললেন।

-আমাদের এই আলোকিত গাঁয়ের আলো আমি তোমায় দিলাম।তুমি এ আলো নিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে দাও নিজের গাঁয়ে।

আমি অবাক হয়ে আলো ভর্তি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম।তিনি বললেন।

-আর দেরী করো না। সবাই জেগে উঠার আগে দ্রুত পৌঁছে যাও নিজের গাঁয়ে।

আমি হাত ভর্তি আলো নিয়ে ফিরে এলাম নিজের গাঁয়ে।তারপর আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে ছড়িয়ে দিলাম আলো।মুহূর্তেই যেন শুরু হয়ে গেল ম্যাজিক। চারদিক আলোতে ভরে উঠল।  বদলে গেলো আকাশের রঙ।হেসে উঠল রামধনু।বাগানে ফুটল উঠল অসংখ্য ফুল। প্রজাপতিরা উড়তে লাগল ফুলে ফুলে।গাছের পাতা,মাঠের ঘাস ধীরে ধীরে সবুজ হতে লাগল।পাখিরা গাইতে শুরু করল।দলেদলে লোক এসে জড়ো হল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। তাদের কাঁধে একে অন্যের হাত,মুখে সুখের হাসি।চোখে মুগ্ধতা আর অবাক বিস্ময়!

আমি আকাশের দিকে চাইলাম। তখন নীলাকাশে ভাসছে সাদা মেঘের ভেলা।আকাশে আমি তাকে স্পষ্টই দেখতে পেলাম। আমি তার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে একটুখানি হাসলাম। মেঘের আড়াল হতে মুখ বের করে তিনিও আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন।আনন্দে আমার চোখ বুঁজে আসলো।

হঠ্যাৎ জোরে ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙল।মা চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন আর বললেন।

-কত বেলা হয়ে গেলো,এখনও উঠার নাম নেই।আর দেরী করলেতো আজ আর ভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস ধরতে পারবিনা।

মা জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন।চোখ খুলতেই তীব্র আলো চোখে লাগল। আমি মায়ের কথা কানে নিলাম না। আবার চোখ বন্ধ করে সুন্দর স্বপ্নটা চোখের সামনে আনার চেষ্টা করলাম।আর মনেমনে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম।

-এ স্বপ্নটা যদি সত্যি করে দাও। তবে আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই আমার।

 

 

লেখকের ইমেইল: tahmina_shilpi@yahoo.com

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here