স্টিফেন হকিংডেস্ক নিউজ :: ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আর নেই। তার পরিবারের মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

বুধবার সকালে ক্যামব্রিজে তার নিজ বাসায় মারা যান বলে তার সন্তান লুসি, রবার্ট ও টিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজ সকালে আমাদের প্রিয় বাবা মারা গেছেন। তিনি একজন মহান বিজ্ঞানী এবং অসাধারণ মানুষ ছিলেন; যার কাজ বহু বছর ধরে টিকে থাকবে। তার সাহস, অধ্যবসায় ও প্রতিভা সারা বিশ্বের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা।’

স্টিফেন হকিং কৃষ্ণগহ্বর ও আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক। ১৯৮৮ সালে ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে ওঠেন হকিং। বইটিতে তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে তত্ত্ব দেন। আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার হিসেবে বইটির এক কোটি কপি বিক্রি হয়। মহাবিশ্ব নিয়ে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ বই ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’। প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ান্স পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদকসহ এক ডজনেরও বেশি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দুরারোগ্য মটর নিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও থেমে ছিল না হকিংয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা। ২১ বছর বয়স থেকেই তিনি এ রোগে ভুগছিলেন।  কিন্তু শারীরিক অক্ষমতা তাকে বিখ্যাত হওয়া থেকে রুখতে পারেনি। হকিংয়ের বাবা ফ্র্যাঙ্ক হকিং ছিলেন জীববিজ্ঞানের গবেষক। আর মা ইসাবেল হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী।

 

স্টিফেন হকিং সম্পর্কে বিস্ময়কর ১০ তথ্য

একজন সাধারণ ছাত্র থেকে শিশুদের বইয়ের লেখক, এরকম নানা অজানা গল্পে ভরা স্টিফেন হকিংয়ের জীবন, যা তার তত্ত্বগুলোর চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর।

খুব কম মানুষই আছেন যারা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনের পথে আছেন; তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আমাদের দুনিয়া দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়েছেন। স্টিফেন হকিং তাদেরই অন্যতম একজন।

স্টিফেন হকিং ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাসের পাতায় তিনি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব যিনি তার সাহসিকতা আর গবেষণার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত তার অনুসারী হয়ে উঠেছিলেন। এগুলো ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক। তার ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম’ অন্যতম সেরা এবং বহুল বিক্রিত বই, বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। এছাড়া তার ‘দ্য ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল’ ভিন্নমাত্রার একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক বই যা তার পরিচয় বহন করবে যুগের পর যুগ।

স্টিফেন হকিংয়ের জীবন নানারকম বিস্ময় আর রোমাঞ্চে ভরপুর। তার গবেষণা জীবনের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন রসিক প্রকৃতির ও চাঞ্চল্যপূর্ণ মানুষ।

* প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছিলেন অপটু
যথেষ্ঠ মেধাবী আর কঠোর পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও স্টিফেন হকিং প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না। স্কুলে তার রেজাল্ট বরাবরই খারাপ ছিল। ক্লাস নাইনে থাকতে তার রেজাল্ট ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়েছিল। যদিও তিনি প্রচুর চেষ্টা করেছিলেন রেজাল্ট ভালো করার।

বিভিন্ন যন্ত্র কিভাবে কাজ করে তিনি সেগুলো খতিয়ে দেখতেন। ঘড়ি, রেডিও এগুলো প্রায়শই খুলে চালাতেন নানারকম গবেষণা। তার শিক্ষক এবং বন্ধুবান্ধব তার খারাপ রেজাল্ট হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতিভার কথা জানতো। তাকে স্কুলে সবাই আইনস্টাইন বলে ডাকতো।

* জীববিজ্ঞানে ছিল বিতৃষ্ণা 
একজন বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও জীববিজ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা ছিল স্টিফেন হকিংয়ের। জীববিজ্ঞানের বিষয়বস্তু অতিরিক্ত বিশদ হওয়ার পাশাপাশি কম নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে তিনি জীবিবিজ্ঞান পছন্দ করতেন না। তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে একাধারে পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের মহাবিশ্বতত্ত্ব পড়াশোনার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন। যদিও মহাবিশ্বতত্ত্ব তখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, তারপরও তিনি নিজস্ব জ্ঞানের পিপাসাবশত এটা নিয়েই পড়াশোনা আর গবেষণায় মগ্ন হয়ে পড়েন।

* তিনি ছিলেন অক্সফোর্ডের নৌচালনা দলের সদস্য
যদিও তিনি বড় ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন কিন্তু তিনি অক্সফোর্ডের নৌচালনা দলের সদস্য ছিলেন এবং শুধুমাত্র নৌকার স্টিয়ারিং আর দাঁড় বাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন। তখনকার দিনে নৌচালনা অক্সফোর্ডে খুব বিখ্যাত ছিল।

* তিনি ছিলেন দৃঢ়সংকল্প এবং আত্মপ্রত্যয়ী একজন মানুষ
স্টিফেন হকিং তার সাহসিকতা আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে সারাজীবন অন্যদের অনুপ্রাণিত করে গেছেন। কিন্তু তার পরিবার তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে যখন তার বয়স ২১। তখন তার তীব্র শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় এবং যুবক স্টিফেন প্রায় অচল হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা খুঁজে বের করেন তার ‘অ্যামিওট্রফিক লেথারাল স্কেলোরসিস’ নামক জটিল শারীরিক সমস্যা আছে এবং তিনি আর কয়েক বছর বেঁচে থাকবেন। এটি ছিল একটি স্নায়ুবিক রোগ যা পেশীগুলো অচল করে দেয়। তিনি চরম মানসিক আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও হতাশ হননি বরং নিজের দৃঢ়ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন।

* সীমাহীন মহাবিশ্বের সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়েছেন 
স্টিফেন হকিং কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের মাধ্যমে সারা জাগানো এক মহাবিশ্বতত্ত্ব উদ্ভাবন করেন যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কার। তার এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, এই সুবিশাল মহাবিশ্ব সীমাহীন।

* মজার মানুষ স্টিফেন হকিং
তার জীবনের নানা মজার ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা হচ্ছে- তার কৃষ্ণগহবর নিয়ে বাজি ধরার ঘটনা। তিনি ২০০৪ সালে স্বীকার করেন যে ১৯৯৭ সালে জন প্রেসকিল নামক একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদের সঙ্গে তিনি কৃষ্ণগহবর নিয়ে বাজি ধরেন এবং সেই বাজিতে তিনি হেরে যান। প্রেসকিল তখন স্টিফেনকে বলেছিলেন যে, তার সব তথ্য কৃষ্ণগহবরে হারিয়ে গেছে।

* স্টিফেন হকিংয়ের পুরস্কার এবং খেতাবসমূহ
স্টিফেন হকিং নিজেই একজন সুবিশাল খেতাবের নাম। তার জীবদ্দশায় তিনি প্রচুর পুরস্কার আর খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৭৪ সালে রয়াল সোসাইটির সদস্য হয়েছেন, পোপ জন পল ৬ষ্ঠ-এর কাছ থেকে পেয়েছেন পায়াস-১১ সোনার মেডেল। তিনি আরো পেয়েছেন রয়াল সোসাইটি থেকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং হুগে মেডেল। তিনি ২০০৯ সালে আমেরিকার সর্বসেরা নাগরিক পুরস্কার প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পান। যদিও তিনি তার জীবনে ১২টি সম্মানজনক ডিগ্রি পেয়েছেন, কিন্তু নোবেল পুরস্কারটি তার পাওয়া হয়নি।

* শিশুতোষ বইয়ের লেখক 
স্টিফেন হকিং ২০০৭ সালে তার মেয়ে লুসির সহযোগী লেখক হিসেবে বাচ্চাদের জন্য একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনিমূলক বই বের করেন। বইটির নাম ‘জর্জ’স সিক্রেট কি টু দ্য ইউনিভার্স।’ বইটিতে আসলে কল্পকাহিনি হিসেবে এক বালকের কথা বলা হয়েছে যে কিনা বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন কলাকৌশলের দুনিয়ায় মগ্ন থাকে। কৃষ্ণগহবরের মতো জটিল বিষয় বাচ্চাদের বোধগম্য করা আর তার গবেষণাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে তিনি এই বইটি লিখেছিলেন।

* তিনি অ্যালিয়েনে বিশ্বাস করতেন
স্টিফেন মহাবিশ্ব নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর বাইরেও প্রাণের অস্তিত্ব বা অ্যালিয়েন আছে। যা সাড়া জাগানো এক মন্তব্য ছিল। তিনি বলেছেন, মহাবিশ্বে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে অ্যালিয়েনের উপস্থিতি আছে। তিনি এটি নিয়ে ডিসকভারি টিভি চ্যানেলে ‘ইনটু দ্য ইউনিভার্স উইথ স্টিফেন হকিং’ নামক শো পর্যন্ত করেছেন।

* তার জীবনীনির্ভর সিনেমা অস্কারে মনোনীত
স্টিফেন হকিং তার গবেষণার পাশাপাশি হাস্যরসাত্মক একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ‘দ্য সিম্পনস’, ‘স্টার ট্রেক’ এর মতো নানান আমেরিকান টিভি শোতে তিনি আসতেন এবং প্রচুর মজা করতেন। হকিং এবং তার স্ত্রী জেইন এর জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’ সিনেমা, যা অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here