[author ]-মুস্তাক মুহাম্মদ[/author]

b2ffbসৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-১২-২৭) বাংলাদেশের আধুনিক দিকপাল কবি। কবিতায় শব্দ নির্বাচনে তার রয়েছে দক্ষতা, পরিমিতিবোধ, সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করার মত। আধুনিক আঙ্গিকে যে অপূর্ব কবিতা বিনির্মাণ শৈলী তা এ সময় কালের উল্লেখ প্রণিধানযোগ্য বটে। বাংলা আধুনিক কবিতায় স্বতন্ত্র্য পরিচয় বহন করে। শব্দের খেলাতে তিনি পটু। তার কবিতায় শিল্পের ছড়াছড়ি।

যার আলংকারিক দিকটাও পাঠককুলকে অভিভূত করে। কবিতায় শব্দের চাকচিক্য সাবলীল-স্বাচ্ছন্দ্য শব্দ বন্দনা অনুস্মরণীয়। পঞ্চপা-ব, শামসুর রহমান’র (১৯২৯-২০০৬) পর আধুনিক কবিতার হাল ধরেছেন তিনি। আধুনিক বাংলা কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক নিপুণ-পেশাদার শিল্পীর মত। বর্তমানের টানাপোড়েন, যুগের যন্ত্রণাকে উপজীব্য করে সৃষ্টিশীল এ কবি লিখে চলেছেন এখনো। পঞ্চপা-বদের মতো আধুনিক কবিতা বিনির্মাণে বর্তমান’র সেনাপতি সৈয়দ শামসুল হক। তার কবিতায় উঠে এসেছে আধুনিক কাল, দেশপ্রেম, বিজ্ঞান। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাকে কবিতায় রূপ দানে তিনি সদা সচেষ্ট।

বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস। বর্তমান বাংলাদেশ একদিনে হয় নি। কালে কালে বিভিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে বর্তমান এই অবস্থানে। সেই সব সংগ্রাম যেমন কৈবর্ত বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, পলাশীর যুদ্ধ, ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ব্যারাকপুরের সিপাহী বিদ্রোহ, বায়ান্ন, ছয় দফা, মুক্তির সংগ্রাম করে অর্জিত বাংলাদেশ। আজ আমরা স্বাধীন। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি। আর বাংলাদেশের অনবদ্য সেই ইতিহাসের কথা সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন-

“আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।/…………./আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরিয়ত থেকে/আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।/…………../ এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে।/এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।” (আমার পরিচয়: কিশোর কবিতা সমগ্র)

যেখানে অত্যাচার নিপীড়ন সেখানেই গেরিলারা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সদর্পে। যেখানে পৃথিবীকে সুন্দর করার ইস্পাত কঠিন শপথ মুক্তির মন্ত্র নিয়ে জাতি-দেশ বিভেদ ভুলে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এই সাহসী সন্তানেরা কোনো শক্তি-রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। তারা আপন শক্তিতে বলিয়ান-উজ্জ্বল। এ বিষয়ে কবি লিখেছেন-

“আফ্রিকার এশিয়ার/নিসর্গে তুমি নতুন বৃক্ষ/নতুন বর্ষা নতুন ফল/দিগন্তে নতুন মাস্তুল/পিতৃপুরুষের চিত্রিত দ-/ দাউ দাউ নাপামের/মধ্যে তুমি হেঁটে যাও/উদ্যত একাকী/জনশূন্য জনপদে উজ্জ্বল এক চিতা।” (গেরিলা)

প্রিয়র মুখের ভাষা এবং নিজের মুখের ভাষা এক হলে মনের ভাব সহজে প্রকাশ করা যায়। আর ভাষার মাধ্যমে মানুষ আন্তিক বন্ধনে বাঁধা পড়ে। এই ভাষা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। ভাষার যথার্থ ব্যবহার করা প্রত্যেকের উচিত। কিন্তু বর্তমানে ভাষার বিকৃত উচ্চারণ হচ্ছে। নিজ ভাষা রেখে অন্য ভাষার ব্যপক চর্চা চলছে। যা শুভ লক্ষণ নয়। দরদি কবি সৈয়দ শামসুল হক তাই লিখেছেন-

“এখন আমার ঠোঁটে শুনি আমি অন্য এক স্বর/ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর।” (আমারে যেদিন তুমি)।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। সাতচল্লিশে হল দেশ ভাগ। পশ্চিম পাকিসত্মানের শোষণে দেশ সম্পদহীন হয়ে পড়তে লাগলো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পেলাম, পূরণ হলো স্বাধীনতার স্বপ্ন। আমরা হলাম স্বাধীন জাতি। কবি শামসুল হক লিখেছেন-

“যখন তিন কোটি মানুষের গৃহত্যাগে বিলীয়মান আমার সভ্যতা,/এখনো তো আমার সভ্যতা;/যখন বলীবধের দ্বিখতি খুরে কম্পমান আমার স্বপ্ন,/প্রিয় ব্রহ্মপুত্র, এখনো তো আমার স্বপ্ন।” (ব্রহ্মপুত্রের প্রতি)

সবুজ-শ্যামল ঘেরা বাংলাদেশ। এখানকার প্রকৃত মানুষ কবি। তিনি সময় পেলে বার বার প্রকৃতির কাছে ছুটে যান। প্রকৃতি থেকে আনন্দ লাভ করেন তিনি। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অবলোকন করেন। বাংলাদেশকে ভালোবেসে এ দেশের প্রকৃতিতে মিশে থাকার বাসনা ব্যক্ত করেছেন এভাবে-

“আমাকে একটি উদ্যান তার চারাগাছ নিয়ে ডাকছে/আমাকে যেতেই হচ্ছে/আমাকে ডাকছে একটি শিশু,/আমাকে ডাকছে একটি রাষ্ট্র,/………/ তোমাদের ভেতর দিয়েই তো সর্বকাল চলে গেছে আমার পথ/এবং সর্বকাল আমি দাঁড়িয়েছি আমি আবার নিয়েছি পথ।” (আমি একটুখানি দাঁড়াব)

মায়ের আঁচলের জন্য তার সাহসী সনত্মানরা যা আছে তাই নিয়ে শত্রু খতমে প্রতিজ্ঞা করে। দেশ-মাতৃকা রক্ষা করার জন্য তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালো রাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নিরস্ত্র বাঙালি দেশ প্রেমের মন্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত-প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নামে। বাঙালির অস্ত্র না থাকলেও তাঁদের অপরিসীম দেশ প্রেমের কাছে পাকিস্তানীরা পরাজিত হয়। কবি লিখেছেন-

“দ্যাখো, আমি নিরস্ত্র। কিন্তু/আমার আছে সেই অস্ত্র যা নিঃশেষিত হয় না,/প্রতি ব্যবহারে তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্মতর হয়ে ওঠে-/আমার প্রাণ।/আমার তো একটিই প্রাণ নয়, কোটি কোটি প্রাণ।” (পহেলা মার্চ ১৯৭১)

শত্রুরা দেশ দখল নিয়েছে। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে দিন চলছে। কিন্তু দেশ প্রেমিক এটা সহ্য করতে পারে না। বাঙালি বীরের জাতি। তারা রক্ত দিতে ভয় পায় না। বাড়ি-ক্ষেত খামার দখল করার জন্য তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। এবং জয় লাভ করে। অর্জন করে লাল-সবুজের একটি পতাকা। কবি এই প্রসঙ্গে লিখেছেন-

“যে আমাকে বাস্তুহারা করেছে একদিন/ সে জানে না মরা কাঠেই আগুন ধরে ভালো-/আবার আমি ঘর তুলব ঘরের অদূরেই/সবুজ দিয়ে গাঢ় লালের শিমুল দেখা যাবে।” (আবার আমি)

প্রজন্ম নিয়ে প্রতিটি মানুষের ভাবনা থাকে। প্রজন্মকে কীভাবে একটি নিশ্চিত সুন্দর-সমৃদ্ধিময় জীবন উপহার দেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে দেশে যে অরাজকতা, দুর্নীতি শুরু হয়েছে তাতে বসবাসের জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ রেখে যাওয়া অনেক কঠিন। দেশের সার্বিক উন্নয়নে সচেতন, দক্ষ, দেশ প্রেমিকের প্রয়োজন। অথচ আজ তার আকাল। সেই কান্ডারীর এবং যোগ্য উত্তরসূরীর জন্য কবি মর্মপীড়া কবিতার পঙ্‌তির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এভাবে-

“আমার কন্যারা,/আমি এসেছি আজ এক স্বপ্নের বীজ সঙ্গে নিয়ে-/তোমাদের জন্যে রোপন করবে এমন কাউকে আমি দেখি না।” (আমার কন্যারা)

চোখ মনের কথা বলে। কেউ যখন কাউকে কথা দেয় তখন তার ওপর একটা আস্থা চলে আসে। নির্ভরশীল হয়। সে দায়িত্ব পালন করবে এই বিশ্বাস থাকে। সুতরাং দায়িত্ব নেওয়ার সময় ভেবে-চিনেত্ম নিতে হবে। তা না হলে বৃহত্তর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কবি সেই কথাই লিখেছেন-

“যখন কেউ কাউকে কথা দেয়/তখন একটি চোখ আঁকা হয়ে যায়।/ তাকিয়ে থাকে সেই চোখ নিস্পলক।” (সেই চোখ)

পুরুষের জীবনে নারী বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান। ত্রিশের পরে একজন যুবক প্রেমের মানে গাঢ়ভাবে বুঝতে শেখে। নারীই পুরুষকে শক্তি-সাহস-আনন্দ দেয়। নারীহীন পুরুষের জীবন প্রায় অন্ধকার। নারী পুরুষের অন্ধকার জীবনকে আলো ঝলমল করে তোলে। সেই কথা লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক এভাবে-

“মৃত্যুকে জীবন দেয়, জীবনের মৃত্যুকে ভোলায়’/কি কান্তি! তোমার তনু এ হৃদয় আসন্ন-সন্ধ্যারপটে নাচায় নিয়ন ॥” (প্রেম, উত্তর-তিরিশে)

প্রেম সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে। সমাজ প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু সমসত্ম নিয়ম ভেঙে যখন প্রেমিকা প্রেমিকের হাত ধরে তখন দেহাতীত এক ভালোবাসার জন্ম হয়। ভালোবাসি ছোট এই শব্দের মধ্য থেকে বের হয়ে আসে নিত্যকাজে প্রেমের প্রকাশই সার্থক প্রেম। কবি লিখেছেন-

“দু’হাত বাড়িয়ে দিলে, হাত ধরতেই। ধুলো হয়ে গেলো সব- সেই দূর কবেকার/যেন গীতগোবিন্দের মূল পান্ডুলিপি;/রাধার রাত্রির মতো আমাদের ভালোবাসা কালের আহার।” (দু’হাত বাড়িয়ে দিলে)

অপূর্ব কবিতা নির্মাতা সৈয়দ শামসুল হক। আধুনিক কালের বিভিন্ন চিত্র তাঁর কবিতার বিষয়-বস্তু আছে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, আছে প্রেম। তিনি লিখে চলেছেন অবিরল। এই সব্যসাচী কবিতায় শব্দ ব্যবহারে অত্যন্ত সাবধানী কিন্তু কৃপণ নয়। শব্দ তার হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কবি ও কবিতা নিশ্চয় কালে কালে মানুষের কল্যাণে দ্রুতি ছড়াবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here