লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: ‘কোরবানির আপোশহীন আনন্দ ছড়িয়ে যাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে’ এই স্লোগানকে ধারণ করে নিম্নবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিত ৮০টি পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন করেছে আলোকিত পাঠাগার পরিবার। এ সময় গরু জবাই করে ৮০টি পরিবারের সদস্যদের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করা হয়েছে। অভিনব এই উদ্যোগটি সফল করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে অবহেলিত মানুষের পাশে বিত্তবানদের দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন আলোকিত পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাবি শিক্ষার্থী আরিফ চৌধুরী শুভ।
সোমবার (১৩ আগস্ট) ঈদের পরের দিন লক্ষ্মীপুর জেলার কুশাখালি ইউনিয়নের ফরাশগঞ্জ, চরমটুয়া, আন্দারমানিক, কালিবিত্তি, নলডগি ও ঝাউডগি গ্রামসহ মোট ৬টি গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত ৮০ পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার ব্যতিক্রমী আয়োজন করে আলোকিত পাঠাগার। এই আয়োজনের সার্বিক সহযোগীতা করেছে জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন।
ঈদের দিন রাত থেকে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি থাকলেও ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে দূর-দূরান্ত থেকে কোরবানির মাংস নিতে আসেন নিম্নআয়ের লোকজন। এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী নুর মোহাম্মদ, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহ বিপ্লব, জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন এবং আলোকিত পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ইঞ্জি. আরিফ চৌধুরী শুভ প্রমুখ।
বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা আয়োজনের জন্য আলোকিত পাঠাগার মানুষের আলোচনায় থাকে। তবে এবার সমাজে সুবিধাবঞ্চিত ৮০ পরিবারের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণের অনন্য উদ্যোগ পিছনের সব আয়োজনকে ছাপিয়ে সবার মুখে মুখে। কুশাখালি ইউনিয়নের কোন সামাজিক সংগঠন হিসেবে গরু জবাই করে অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার ঘটনা এটিই প্রথম বলে দাবি করেছেন এই ইউনিয়নের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও মাংস নিতে আসা অনেকেই।
তবে অত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, আলোকিত পাঠাগার বরাবরই ভালো কাজ করে যাচ্ছে সমাজের জন্য। নানামুখী সামাজিক কাজের জন্য তারা বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছে। তবে এবার যে কাজটি তারা করেছে সেটি নি:সন্দেহে চমৎকার কাজ। যে ছেলেটা এই সব করছে, সেতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দেশের প্রতি, এলাকার প্রতি তার বাবার মতো তার একটা টান রয়েছে। এলাকায় আসলে আমার মতামত নেয় সে।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহ বিপ্লব বলেন, যেকোন ভালো কাজকে আমাদের সমর্থন দিতে হবে। আরিফের মতো তরুণদের এই সমাজে আজ বড্ড প্রয়োজন। আরিফ তার সমাজে দৃষ্টান্ত রেখেছে। সে ছাত্রাবস্থা থেকে একটি অন্ধকার গ্রামকে আলোকিত করার জন্য স্কুল পাঠাগার দিয়েছে একক চেষ্টায়।শতাধিক বুবিধাবঞ্চিত পরিবারের মিশুদের দায়িত্ব নিয়েছে তার আলোকিত স্কুল। এই চেষ্টাই আজ তার মতো তরুণদের কতজনের আছে? আরিফদের কাজ থেকে আমরাও শিখছি। আরিফের ডাকে তাই ছুটে এসেছি ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে।
আলোকিত পাঠাগারের এই আয়োজন সম্পর্কে উদ্যোক্তা আরিফ শুভ বলেন, আয়োজনের বিস্তারিত নিয়ে আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছি।সেখানেও বলেছি। তাছাড়া সমাজটাতো আমাদের, তাই দায়িত্বটাও আজ আমাদেরই। আমরা যতবড় শিক্ষিত হচ্ছি আজ, ততই সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করছি বিভিন্নভাবে। কিন্তু আমি মনে করি আমার সমস্ত অজর্নে এই মানুষগুলোর কিঞ্চিত হলেও ঋণ রয়েছে। তাই ভিক্ষা করে হলেও তাদের ঋণ শোধ আমাকে করতেই হবে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি এখনো।
আয়োজনের বিস্তারিত নিয়ে আরিফ শুভ ফেসবুকে লেখেন,
আমার এই পথ চাওয়াতে আনন্দ…
কোরবানরি আপোশহীন আনন্দ ছড়িয়ে যাক প্রজন্ম থকেে প্রজন্ম। আজ এই আনন্দের অংশিদার হতে পেরে আমি/আমরা আনন্দিত। এই আনন্দ উৎর্সগ করছি তাদের প্রতি, যারা একটি গরু কেনার জন্য আমাকে আর্থিকভবে সহযোগিতা করছেনে নিজেদেরে সাধ্যমত। এই মানুষগুলোর জন্য আপনাদের কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে গলোম। আল্লাহ আপনাদের দান কবুল করুন।
এক বৃদ্ধ মা আজ মাংসের পোল্টা হাতে পেয়ে হাউ মাউ করে কেদে দিলেন। আমি মাকে বললাম মা উনি কাদছেন কেন? তিনি কি গোশত পাননি? পরে সেই ভিক্ষুক মা অশ্রু মুছতে মুছতে বললেন, আমি ভিক্ষার মুষ্টির চাল জমিয়ে কদিন আগেই মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি। আমার মেয়ের যে বিয়ে হবে, এটাইতো আমি চিন্তা করিনি কখনো। মেয়ের জামাইকে কোরবানির ঈদে দাওয়াত দিয়ে গরুর গোশত দিয়ে ভাত/রুটি খাওয়ানোর জন্য মেয়ে কতবার বলে গেল। আল্লাহ মেয়ের ইচ্ছে কবুল করেছে। এই গোশত আমার ইজ্জত রক্ষা করবে নতুন জামেইয়ের কাছে। বৃষ্টিতে ভিজে তিনি বহু দূর থেকে এসেছেন মাত্র ১ প্যাকেট মাংসের জন্য। আমি জানি নাই, আমার ভেতরটা কখন যে বৃষ্টির জলের সাথে একাকার হয়ে গেল।
আরেক মা ঈদের কদিন আগেই সড়ক দৃর্ঘটনায় তার সন্তান হারিয়েছেন। যারা কবর খুঁড়েছিল, তাদের একটু ভালো খাওয়াবেন বলে আজ ৩দিনই ধরে আমাদের বাড়ি এসে বসে থাকতেন আর মাংসের কথা বলে যেতেন যাবার বেলায়। এই আয়োজন না করলে আমার হয়তো জানাই হতো না, আমাদের আত্মার পাশেই কতো মানব আত্মা আমাদের দিকে চেয়ে থাকে, কিন্তু আমরা তা কখনো বোঝার চেষ্টাই করি না।এই সমাজ আমাদেরই, কিন্তু এই দায়িত্বটা কার? সামাজিকতা ও লজ্জার ঘোমট ভেঙ্গে কেউ এগিয়ে এসে বলে আর কেউ বলে না। গোশত হাতে বেশিরভাগ মানুষের মনের আত্মতৃপ্তির ভাষা আলাদা, কিন্তু তাদের আর আমাদের প্রত্যেকের রক্তের রঙ কিন্তু একই। ঈশ্বরের কাছে যখন হাত তোলেন তারা, তখন প্রত্যেকেই শান্তির বার্তা কামনা করেন। আল্লাহ সবার দোআ কবুল করুন দানকৃতদের জন্য।
আমি/আমরা/ আলোকিত পরিবার চেষ্টা করেছি, ফরাশগঞ্জ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার। তারাও যেন নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অন্তত একবেলা কোরবানির মাংস পেট পুরে খেতে পারে সেই ব্যবস্থা করার। আমরা জানি না আমরা কতটুকু করতে পেরেছি, কিন্তু কিছু একটাতো হলো।
আজ ৮০টি পরিবারের সদস্যদের মাঝে ১.৫” কেজি করে কোরবানির মাংস ও হাঁড় তুলে দিয়েছি। নাড়িভুড়ি মিলিয়ে মোট মাংস হয়েছে ১০৫ কেজি। তার পরেও যারা খালি হাতে ফিরে গেছেন, সন্ধ্যার পরেও অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজে অনেক দূর থেকে বাড়িতে এসেছেন মাংসের খোঁজে কিন্তু দিতে পারিনি, তাদের জন্য আমার বড্ড আপসোস হয়।
কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা তাঁদের প্রতি, যারা আলোকিত পাঠাগারের এই আয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন এবং যারা ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলোর সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে উপস্থিত হয়েছেন।
ঈদের ২০ দিন আগে আমি আমার গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত ও নিম্নবিত্তের ৪০ পরিবারের জন্য কোরবানির ১ কেজি করে মাংস দেয়ার জন্য আমার ফেসবুকে বন্ধুদের থেকে মাত্র ৪০ জন মানুষের সহায়তা চেয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছি। আমার ইচ্ছে ছিল ৪০ জন মানুষ মাংস ও মোসলার দামসহ অন্তত ১০০০ করে টাকা দিলে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি মাঝারি সাইজের গরু কিনবো। কিন্তু আমার পাশে এই আয়োজনের জন্য আমি মাত্র 23 জন মানুষকে পেয়েছি।
মোট ওঠেছে ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। আমাদের গরুর দাম ৪৫ হাজার। গরুর মালিক বাজার দাম থেকে ৫ হাজার টাকা কম রেখেছেন এই আয়োজনের কথা চিন্তা করে।
মোট খচর হয়েছে ৪৬ হাজার ৩২০ টাকা।এখনো ঘাটতি আছে ১৩ হাজার ৮২০ টাকা। এই টাকা Alokito Pathager পাঠাগার ভবিষ্যতে কোথাও ফান্ড পেলে পরিশোধ করবে। না হয় আমাকেই দিতে হবে।
সার্বিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ Jatiyapathager Andolon/জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন ও Alokito Pathager আলোকিত পাঠাগারকে।