সাহানা খানম শিমু

সাহানা খানম শিমু :: বাবার অস্থিচর্মসার নিথর দেহটা কবরের গহীন ঘরে শুইয়ে দিতে দিতে ডাঃ আকিব দেওয়ান, ‘বাবাকে কি আমি নিজ হাতে মেরে ফেললাম? একটা ডেথ সার্টিফিকেট অথবা সুস্থতার প্রত্যায়ন পত্র কি আমার খুব দরকার ছিল! বেঁচে থাকার জন্য বাবার করুণ আকুতি আমি কেন শুনতে পেলাম না? আমি কেন এমন করলাম? বাবা কি তার প্রিয় ছেলে আকিবের মৃত্যুকে এভাবে ত্বরান্বিত করতে পারতেন? আমার কাছে বাবা অনেক প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন, তাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসতাম। তাহলে কিভাবে পারলাম এমন জঘন্য কাজ করতে?’

মৃত্যুর চতুর্থতম দিন, শুক্রবার বাদ জোহর বাবার চেহলাম এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে রাতেই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সুবিশাল এয়ার বাসে চড়ে কানাডার উদ্দেশে রওয়ানা দিল ডাঃ আকিব দেওয়ান। ফিরে যাচ্ছে স্ত্রী মিলা, ছেলে প্রিন্স এবং মেয়ে ডানার কাছে। গত দু’সপ্তাহ শরীর মন দুটোর উপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রচন্ড ঝড়। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিল প্লেনের আরামদায়ক চেয়ারটিতে। নিজেকে এমন নির্ভার লাগছে কেন? যেন বিরাট কঠিন কোন দায়িত্ব সুনিপুণ হাতে নিষ্পন্ন করলো।

কানাডায় থাকা অবস্থায় প্রায় প্রতিদিন বাবা মায়ের সাথে কথা হতো আকিবের। বাবার সাথে প্রতিদিন কথা না হলেও মায়ের কাছেই বাবার সব কথা শোনা হত। বাবাকে নিয়ে মায়ের কথার বেশির ভাগ জুড়েই থাকত অনুযোগ আর অভিযোগ। হয়তো আর কারো কাছে বলতে পারেন না, তাই আকিবকে বেছে নিয়েছেন।একদিন বলছেন, ‘তোদের বাবাকে নিয়ে আর পারি না, পছন্দের খাবার পেলে হুঁশ থাকে না। হজম করতে পারে না তবুও খাবে,আজ দুপুরে রুই মাছের মুড়োঘন্ট বেশ অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে। এরপরই পেটের সমস্যা। সন্ধ্যারাতের মধ্যেই কয়েকবার বিছানা,কাপড় চোপড় নষ্ট করেছে। কে এগুলো সাফ করে? আমার বয়স হয়েছে না? হোসেনের মাকে সাথে নিয়ে কত কষ্ট করে সাফ করলাম। এখন ব্যথায় আমি কোমর নাড়াতে পারছি না।’

এমনি আরেকদিন সকালে হাঁটতে যেয়ে পড়ে গিয়ে পায়ের পাতার হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গেলো। মাকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনতে হলো।

এই রকম ছোট বড় হাজারটা সমস্যার কথা প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয় আকিবকে। নিজের মতো করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
মা তোমাকে কতদিন ধরে বলছি বাবার জন্য একটা ভালো লোক রেখে নাও। এখন তো বাংলাদেশেও হেলথ ওয়ার্কার পাওয়া যাচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টার সার্ভিস পাবে। আমি দেশে এসে ঠিক করে দিয়ে যাই? দিনে রাতে দুজন ওয়ার্কার বার ঘন্টা করে ডিউটি করবে। বাবার গোসল, খাওয়ানো সব কাজ করবে। বাবাকে নিয়ে হাঁটতে যাবে। তখন তোমার উপর প্রেসার কম হবে। রাজি হও মা, তাহলে আমি দেশে এসে সব ব্যবস্থা করে দিয়ে যাই।
নারে, আমি বাড়িতে একা একা থাকি। হোসেনের মা সন্ধ্যায় চলে যায়। বাড়ির মধ্যে বাইরের অচেনা লোক ঢুকাতে পারব না। তোরা কেউ দেশে থাকলে লোক রাখতে আমার কোন সমস্যা ছিল না।

আকিব মাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে লাভ হয়নি। মা আতঙ্কিত থাকেন। চারিদিকে ঘটে যাওয়া নানা রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা দৈনিকে পড়ে,টিভি চ্যানেলে দেখে মা স্বস্তিতে থাকতে পারেন না। বাবার বয়স হয়েছে, প্রায় আশির কাছাকাছি। বাবা মায়ের বয়সের পার্থক্য পনর বছরের মতো। থাকেন একতলা পুরোনো স্টাইলে তৈরি সাধারন বাড়িতে। এখন চারিদিকে নতুন নতুন আকাশ ছোঁয়া সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্টের মাঝে কেমন বেমানান লাগে। তবে যখন আকিব আরশি ছোট ছিল, কত আনন্দময় ছিল বাড়িটি। সারা দিন পুরো বাড়ি জুড়ে দৌড়াদৌড়ি লেগেই থাকত। বাড়ির পিছনে ছিল এক চিলতে জায়গা সেখানে ক্রিকেট খেলত দুই ভাইবোন। মা কত রকম গাছ লাগাতেন। দেয়ালের কাছ ঘেঁসে ছিল নারকেল, সুপারী, আম জাম, কাঠাল, মেহগনি, কদম কত না গাছ। এমনকি জামরুল, করমচা গাছও ছিল। গাছগুলো এখনও আছে তবে রায়হান রোকেয়ার মতো ওরাও বয়সের ভারে ম্রিয়মাণ। যদি আজ আকিব আরশি কাছে থাকত তবে কি এমন প্রাণহীন সময় কাটত রায়হান রোকেয়ার ? অবশ্যই তা হতো না। ছেলেমেয়ে দুটো ওদের বাচ্চা কাচ্চাদের নিয়ে যদি কাছে থাকত! তাহলে রায়হান রোকেয়ার সাথে যেন পুরো বাড়ি হেসে উঠত। কিন্তু তা হবার নয়। এখন শুধু ক্লান্ত চোখে অপেক্ষার প্রহর গোনা, নিসার সময় অতিক্রম করা।

রায়হান বেশ কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ থাকছে। ডায়াবেটিস, প্রেসার, অনিদ্রা,হাড়ের সমস্যা। রোকেয়ার শরীরেও অসুখ বাসা বেঁধেছে। আসলে ছেলেমেয়ে দুটো দূরে থাকায় দু:শচিন্তায় এরা দুজন এত দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

গত বছর জুন মাসে একবার এসেছিল বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে। সেবার মিলার অফিস, বাচ্চাদের স্কুল সব ফেলে পুরো পরিবার নিয়ে ছুটে এসেছিল বাবাকে দেখতে। আকিবের একমাত্র বোন, আরশি অস্ট্রেলিয়া থেকে বাবার অসুখের খবর পেয়ে স্বামীকে রেখে ছোট ছেলে কোলে নিয়ে ছুটে এসেছিল। আরশি খুব হুলস্থুল কাণ্ড করছিল, একবার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আবার আকিবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আকিব বোঝে ওর কষ্ট। বাবা মাকে ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া বেশি দিনের নয়। অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাত্রার সাথে ধাতস্থ হতে পারেনি তখনও। এ অবস্থায় এমন একটা খবর ওকে অনেকটা এলোমেলো করে দিয়েছিল। বাবাকে হসপিটালে ভর্তি, সেবা-শুশ্রুষা করে আকিব আরশি প্রায় দু সপ্তাহ দেশে থেকে বাবাকে মোটামুটি সুস্থ করে, বাসায় রেখে তবে ফিরে গিয়েছিল নিজেদের কর্মস্থলে।

এ বছর মার্চেও বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে একাই দেশে এসেছিল আকিব। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় বাসায় রেখে ফিরে গিয়েছিল।

আকিবের এবারকার দেশে আসাটা কিছুটা ভিন্ন। যদিও বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে এসেছে তবুও। মায়ের মুখে অসুস্থতার বিবরণ, টেস্টের ধরন ইত্যাদি শুনেই ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের ডাক্তার আকিবের আত্মা ধ্বক করে উঠেছিল,ল্যাং ক্যান্সারের নামটা মাথায় এসেছিল, উচ্চারণ করেনি মায়ের কষ্টের কথা মনে করে।

এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাসায় এসে বাবাকে দেখে বিস্ময়ে ভেঙ্গে পড়ল আকিব। বাবা অনেক শুকিয়ে গেছেন, গলার হাড় বসে গেছে। আকিবকে দেখে বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আকিব বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল।।

পরদিন সকালেই নামকরা হসপিটালে ভর্তি করিয়ে সব টেস্ট আবার করে করাল। সন্ধ্যা নাগাদ রিপোর্ট হাতে চলে আসে, আকিবের মুখটা ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে যায়। খুব ভাবছিল আগের রিপোর্টগুলো যদি ভুল হত! না, তা হল না। গতবারের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি, কোন পরিবর্তন নাই। বাবার ফুসফুসে একটা ছোট লাম্পের মতন হয়েছে। এটা ফুসফুসের ক্যান্সার, ডাক্তার তাই আশংকা করছেন এবং উনি ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন। রায়হানকে এখন মেডিসিন দেয়া হচ্ছে।

আকিব বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। সুতরাং মা এবং আরশি ওর মুখের দিকেই চেয়ে আছে, ওকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার উপর আকিব নিজেও একজন স্পেসালাইজড ডাক্তার তাই বাবার বিষয়ে ওর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ফুসফুসের ক্যান্সার অপারেশন করে হয়তো খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না। তবে অপারেশন না করলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থেকে যায়। আবার বাবার শরীরের যা অবস্থা তাতে অপারেশন করে ভাল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

আকিব নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে একটা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে দিল। বোর্ডের সেও একজন মেম্বার। বোর্ড মিটিং চলছে, স্পেসালাইজড ডাক্তারেরা তাদের মতামত শেয়ার করছেন।

মি: রায়হানের চিকিৎসা দুটো পদ্ধতিতে করা যেতে পারে।

প্রথমত কনজারভেটিভ পদ্ধতিতে চিকিৎসা হবে। এ পদ্ধতিতে মেডিসিনের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ গুলোর দ্রুত বৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে, যাতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে না পারে। কোষগুলোকে বাঁধা দেয়া এবং সীমাবদ্ধ জায়গায় আটকে রাখার চেষ্টা করা। এতে খুব ভালো ফল না পাওয়া গেলেও তার বয়স বিবেচনায় এই পদ্ধতিতে যাওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়টি হলো আধুনিক, এই পদ্ধতিতে অপারেশনের মাধ্যমে ফুসফুসের আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে। এতে যতদিন বাঁচবে ভালো ভাবে বেঁচে থাকবে। ক্যান্সারের ঝামেলা থাকলো না। তবে কোন পদ্ধতিতেই অবশ্যই বলা যাবে না যে রোগী একশত ভাগ ভালো হয়ে যাবেন।

বোর্ড মিটিং চলছে,চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সবার জন্যই কঠিন হচ্ছে। তবে আকিব কানাডার কয়েকটি উদাহরণ টানল,

রোগীর বয়স নব্বই-এর উপরে তবুও অপারেশনকেই ঐ সব দেশে অগ্রাধিকার দেয়। কনজারভেটিভ পদ্ধতি খুব একটা প্রচলিত নয় উন্নত বিশ্বে। বোর্ডের অন্য মেম্বারদের বুঝতে অসুবিধা হল না রোগীর সন্তানের আগ্রহের দিকটা। সুতরাং বোর্ড সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল তারা অপেরেশনেই যাবেন। অর্থাৎ ধুকে ধুকে বেঁচে থাকা নয়। বাচলে সুস্থ, সন্দুর সবল ভাবে বাঁচা।

রায়হানের মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল যখন নার্স মেয়েটি বলল-
এই ওষুধগুলাকে খেয়ে নেন, পরশু আপনার অপারেশন।

ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে যেয়ে চুপ করে গেল। নিরবে ওষুধগুলা খেল। সন্ধ্যায় ছেলে আকিব কাছে এলে হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়ানো গলায় বললেন,

বাবা, বাবারে, আমাকে অপারেশন না করালে হয় না? আমি তো আর ভালা হব না। এভাবে যে কটা দিন বেঁচে থাকতে পারি। শুধু শুধু কাটা-ছেঁড়া করে কি হবে? বাবা তুই তো নিজেই কত বড় ডাক্তার, তুই এদের না করে দে। তোর ‘না’ এরা শুনবে। বল আমি অপারেশন করাতে চাই না।
বাবার বরফ শীতল হাত দুটো আকিবের হাতের ভেতর থির থির করে কাঁপছে।

বাবা তুমি ভালামতো বাঁচতে চাও না? অপারেশন করালে তুমি পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে। সুন্দর সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে বাবা।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখল অনেকক্ষণ। বাবা শিশুর মতোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আকিব আর কথা না বলে, বাবার সাড়া গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

এরপর বাবা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলেন। সিস্টার, ওয়ার্ড বয়দের কথা মতো নিরবে ওষুধ খায়, অন্য সব কাজ করে কোন প্রতিবাদ করে না। বুঝে গেছে এখানে প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না, প্রতিবাদের ধ্বনি শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে। অপারেশন টেবিলে তাকে যেতে হবে, ছুড়ি কাঁচির নিচে তাকে শুতে হবে।

অপারেশন থিয়েটারে নেবার আগে বাবা আবার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে, যেন শেষ চেষ্টা, শেষ আকুতি জানালেন আকিবকে জড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদছে আর বলছে,
বাবা আমাকে ওটিতে নিস না। তুই না কত বড় ডাক্তার। তুই এদের বল আমার অপারেশন লাগবে না। তুই বললে ওরা শুনবে। ওটিতে নিলে আমি আর ফিরবো নারে আকিব, আর ফিরব না।

বাবার কথা শুনে আকিব পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। আকিবের ডাক্তার জীবনে এরকম দৃশ্য অনেকবার, অনেকবার দেখেছে। অপারেশনের আগে রোগীরা মৃত্যু ভয়ে কাতর থাকে, ওটিতে যেতেই চায় না, খুব কান্নাকাটিও করে। তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে অপারেশন করার পর বেশির ভাগ মানুষই সুস্থ জীবন যাপন করে।পরে ঐ সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলে, লজ্জিত হাসি হাসে। বাবার ক্ষেত্রে কি হবে? মনে প্রশ্নের দোলাচল। বাবার আকুতি শুনে খুব ইচ্ছে হচ্ছে অপারেশনটা থামিয়ে দিতে। কিন্তু কিভাবে? নিজের এই দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে এই ধরনের খামখেয়ালি আবদার কি রক্ষা করা যায়? যেখানে ডাক্তার, ওটি সবকিছু তৈরি। সুতরাং বাবাকে বুঝানোর চেষ্টা।

বাবা দেখো কিছু হবে না, তুমি ভালো হয়ে যাবে। বাবা আকিবকে ছেড়ে এবার স্ত্রী রোকেয়ার হাতটা টেনে ধরলেন,

রোকেয়া ওদের না করে দাও। আমি এখন থেকে তোমার সব কথা শুনব। আর উল্টাপাল্টা করব না। এবার আমাকে বাসায় নিয়ে চল, দেখো আমি কি করি। আমি তোমার কথার বাইরে যাব না। তোমার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনব। রোকেয়া আমার কথা শুনছ? ওদের থামাও রোকেয়া।
তুমি অস্থির হয়ো না তো। অপারেশন শুধু শুধু করছে না, প্রয়োজন তাই করছে। তোমার ছেলে,,আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি, তুমি সুন্দরভাবে বাঁচবে তাই চাই। সাহস রাখো মনে, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না। আল্লাহকে ডাকো, সব ভালো মতো হবে।

ট্রলি নিয়ে ওটি সিসটার কেবিনে ঢুকল। যান্ত্রিকভাবে একটার পর একটা কাজ করে রায়হানকে এক সময় ওটি ট্রলিতে উঠিয়ে ধীরে ধীরে ওটির দিকে নিয়ে যেতে থাকল। আকিব এবং রোকেয়া ট্রলির সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাবার হাতটা আকিব শক্ত করে ধরে রেখেছে। অন্য হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

কিছু হবে না বাবা, কিছু হবে না। তুমি ভালা হয়ে ফিরে আসবে।
রায়হান কোন কথা বলছে না, বোবা প্রাণীর মতো শুধু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।

সময় যেন এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। আকিব রোকেয়া বসে আছে, ওটি এর দরজার বাইরে। দরজা খোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। বন্ধ দরজা আর খুলছেই না। প্রায় ছয় ঘন্টা পর ওটির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সার্জন, এনাসথেটিস্ট। আকিব এগিয়ে যেতেই সার্জন এক মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করল। যা থেকে আকিব বুঝে নিল-তেমন ভালো খবর কিছু নয়।

রায়হান পোষ্ট অপারেটিভ বিছনায় শুয়ে আছে অবচেতন অবস্থায়। অপারেশনের পর অবস্থার আর উন্নতি হয়নি। কথা বলেনি, চোখ খুলেনি, নিজ থেকে কোন খাবার গ্রহণ করেনি, স্যালাইন চলছে। মাথা হাত-পা সম্পূর্ণ শরীর জুড়েই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে আটকানো। মনিটরে দেখাচ্ছে বর্তমান অবস্থার চিত্র গুলো। চেতন আর অচেতনের মাঝামাঝি অবস্থান। আকিবের খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কিন্তু বাবা কিছু শুনবার বা বলবার উর্ধ্বে উঠে গেছেন। তবুও পোষ্ট অপারেটিভের বিছানায় অচেতন বাবার প্রায় নিথর হাতটা ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল আকিব।

রায়হান দুদিন ছিলেন এই অবস্থায়। তারপর সব মায়া ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

প্লেনের ফার্স্ট ক্লাসের এত আরামদায়ক চেয়ারে শুয়েও ঘুম আসছে না আকিবের। এই পনের দিনের পুরো ধকলটা ওর উপর দিয়েই গেছে। দেশের মাটিতে বাবাকে শুইয়ে ফিরে যাচ্ছে কানাডায়। প্লেনে বসেই বাবার কাছে ক্ষমা চাইছে আকিব-
বাবা আমার ভুল হয়েছে। তুমি আর কটা দিন নির্বিঘ্নে বাঁচতে চেয়েছিলে। আমি তোমায় তা দিলাম না। তোমার মরণ অসুখ ধরেছিল, আমি তা জয় করে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। পারলাম না বাবা, পারলাম না!
আকিবের মনের গহীন থেকে কে যেন বলে উঠে।

আসলে কি তাই? তুমি চেয়েছিলে একটা সার্টিফিকেট! হয় মায়ের দেয়া সুস্থতার সার্টিফিকেট, নাহলে একটা মৃত্যুর সার্টিফিকেট। তুমি আর অসুস্থ বাবাকে টানতে চাওনি। তুমি চেয়েছিলে ফয়সালা। হয় এসপার না হয় ওসপার। তুমি একটা শেষ দেখে, নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যেতে চেয়েছ প্রবাস জীবনে, নিজের কর্মস্থলে। তুমি তোমার মায়ের নিশ্চিন্ত জীবন চেয়েছ। চেয়েছ বাবা বেঁচে থাকলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে। তাই নয় কি?

আকিবের চেতন প্রতিবাদ করল অবচেতনের,
কে না চায় উন্নত চিকিৎসা? কে চায় চুপ করে ঘরে বসে থেকে মৃত্যুর দিন গুনতে। তার চাইতে কি শ্রেয় নয় চিকিৎসার আশ্রয় নেয়া?

প্লেনের আরামদায়ক চেয়ারে বসে দ্বন্দ্ব হচ্ছে চেতনে আর অবচেতনে। আকিবের মতো বাস্তববাদী লোকের কাছে চেতনেরই জয় হয়। বসার সিটটা পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, বোতাম টিপে সিটের নিচ থেকে ফুট রেষ্টটা বের করে পা তুলে দিয়ে আধাশোয়া শুয়ে গেল দ্বন্দ্ব জয়ী ডা. আকিব দেওয়ান।

 

 

 

 

লেখকের ইমেইল: shemu@live.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here