স্টাফ রিপোর্টার :: দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে মাইডাস ভবনে টিআইবির কার্যালয়ে এ জরিপ তুলে ধরা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।
জরিপ অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত খাত যথাক্রমে পাসপোর্ট ও বিআরটিএ।
টিআইবি কর্তৃক পরিচালিত ‘সেবাখাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৬.৫% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
পরিসংখ্যানগত তাৎপর্য (significance test)-এর নিরিখে এই হার ২০১৫ সালের খানা জরিপে প্রাপ্ত হার (৬৭.৮%) এর সমান (গড়পরতভাবে ১.৩ পয়েন্ট কমলেও তা পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়)। ২০১৭ সালে ৪৯.৮% খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে যা ২০১৫ সালের তুলনায় ৮.৩ পয়েন্ট কম। তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার খানার হার কমলেও ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। খানা প্রতি বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৪,৫৩৮ টাকা থেকে ১৩৯২ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৫,৯৩০ টাকা। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৮,৮২১.৮ কোটি টাকা থেকে ১৮৬৭.১ কোটি টাকা বা ২১.২% বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,৬৮৮.৯ কোটি টাকা, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪% এবং বাংলাদেশের জিডিপি’র ০.৫%।
জরিপে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭২.৫%), পাসপোর্ট (৬৭.৩%), বিআরটিএ (৬৫.৪%), বিচারিক সেবা (৬০.৫%), ভ‚মি সেবা (৪৪.৯%), শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) (৪২.৯%) এবং স্বাস্থ্য (৪২.৫%)। তবে শুধু ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ বিবেচনায় সেবা নিতে গিয়ে বিআরটিএ খাতে সর্বাধিক খানা (৬৩.১%) ঘুষের শিকার হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট সেবায় ঘুষের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ৬০.৭% ও ৫৯.৩% খানা। তবে খাতওয়ারী হিসেবে বিভিন্ন খাতে খানা প্রতি প্রদত্ত গড় ঘুষের পরিমাণ বিবেচনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান পঞ্চম।
২০১৭ সালের খাতওয়ারী হিসেবে প্রতিটি খানা গ্যাস খাতে গড়ে ৩৩৮০৫ টাকা (সর্বোচ্চ), বিচারিক সেবা খাতে ১৬৩১৪ টাকা, বীমা খাতে ১৪৮৬৫ টাকা, ভূমি সেবা খাতে ১১৪৫৮ টাকা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খাতে ৬৯৭২ টাকা ঘুষ দিয়েছে। ঘুষ বা নিয়মবর্হিভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটি চিহ্নিত করেছে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৮৯% খানা, ২০১৫ সালে যার হার ছিল ৭০.৯%। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের খানাগুলোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকৃতি ও মাত্রা নিরূপণসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিপারপাস সেম্পলিং ফ্রেম-এর আলোকে দেশের আটটি বিভাগে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের সমন্বয়ে তিন পর্যায় বিশিষ্ট স্তরায়িত গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতিতে জরিপটি পরিচালিত হয়। জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত খানাসমূহ ১৫টি প্রধান ও অন্যান্য খাতে যেসকল সেবা গ্রহণ করেছে তার ওপর ভিত্তি করে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ ২০১৮ জরিপের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আটজন বিশেষজ্ঞের সার্বিক সহায়তা ও পরামর্শ গৃহীত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্ব ও প্রভাব রয়েছে এমন ১৫টি প্রধান খাতসহ ওয়াসা, বিটিসিএল ও ডাকসেবাকে ‘অন্যান্য খাত’ হিসেবে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৫টি প্রধান খাত হলো: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা এবং গ্যাস।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, বিআরটিএ, স্বাস্থ্য (সরকারি), বীমা ও এনজিও খাতে দুর্নীতি বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষা (সরকারি ও এমপিও ভূক্ত), পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা, কর ও শুল্ক এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খাতে দুর্নীতি কমেছে। তবে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। আবার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কৃষি, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, বীমা, স্বাস্থ্য (সরকারি), গ্যাস ও এনজিও খাতে ঘুষের শিকার খানার হার বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষা (সরকারি ও এমপিও ভূক্ত), পাসপোর্ট, ভ‚মি সেবা, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং খাতসহ ‘অন্যান্য খাত’ (ওয়াসা, বিটিসিএল, ডাকসেবা ইত্যাদি) এ ঘুষের শিকার খানার হার কমেছে। তবে সার্বিকভাবে ঘুষের হার কমলেও দায়িত্ব পালনে অনীহা, অসদাচরণ ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপ প্রভৃতি অনিয়ম-দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আত্মসাৎজনিত দুর্নীতি কমেছে। পাশাপাশি হয়রানি বা জটিলতা এড়ানো, নির্ধারিত ফি জানা না থাকা এবং নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়া খানার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পক্ষান্তরে, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রæত সেবা পাওয়া এবং অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ঘুষ দেওয়া খানার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বিভিন্ন খাতে সরকারের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, তদারকি বৃদ্ধি এবং স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে এবং কয়েকটি (৭টি) সুনির্দিষ্ট খাতে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার হারের তারতম্য লক্ষণীয়। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত ও দরিদ্র খানাসমূহ দুর্নীতির শিকার বেশি হচ্ছে। ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণকালে শহরাঞ্চলের ৬৫% খানার বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের ৬৮.৪% খানা দুর্নীতির শিকার হয়। আবার, শহরাঞ্চলের ৪৬.৬% খানার বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের ৫৪% খানা ঘুষের শিকার হয়। খানার প্রধান নিরক্ষর এমন ৭০.১% খানা দুর্নীতির শিকার হওয়ার বিপরীতে খানার প্রধান স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ্ব এমন ৫৮.৮% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আবার খানা প্রধানের পেশা কৃষিকাজ বা মৎস্য চাষ এমন ৭৬.৫% খানা, জেলে ৭৫.৯% খানা, পরিবহন শ্রমিক ৬৯.৮% খানা, অবসরপ্রাপ্ত ৬৯.৭% খানা দুর্নীতির শিকার হওয়ার বিপরীতে পরিবার প্রধান আইনজীবী, চিকিৎসক বা প্রকৌশলী এমন ৫৯.৯% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
এছাড়া উচ্চ আয়ের তুলনায় নি¤œ আয়ের খানার ওপর দুর্নীতির বোঝা অপেক্ষাকৃত বেশি। সেবা গ্রহণকালে ঊচ্চ আয়ের খানাগুলো বার্ষিক আয়ের ০.১২% এবং নিম্ন আয়ের খানাগুলো বার্ষিক আয়ের ২.৪১% ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। ১৭ বছর বা তার কম বয়সী সেবাগ্রহীতাদের ৩২.৬% দুর্নীতির শিকার হওয়ার বিপরীতে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী সেবাগ্রহীতাদের ৪৪.১% দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না- এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। যাঁদের ওপর দায়িত্ব তাঁরা দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনছেন না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘুষ ও দুর্নীতি মেনে নেওয়া সার্বিকভাবে আমাদের জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে জাতি হেসেবে আমরা আমাদের আত্মবিশ^াস, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছি।’’
কিছু সূচক ও খাতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও সার্বিকভাবে দেশের দুর্নীতির চিত্র উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ কমে যাবে বলে অনেকের প্রত্যাশা থাকলেও গবেষণার ফলাফল বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন কমেছে যার পেছনে বর্ধিত বেতন-ভাতাসহ অন্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করে অভ্যস্ত তাদের জন্য বেতন-ভাতা কোন বিষয় নয়। তারা বেতন-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করেন দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।” দুর্নীতি প্রতিরোধে কী করতে হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. জামান বলেন, “সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেবা গ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী, পর্যবেক্ষক ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আন্তরিক হন এবং দুর্নীতির বিচারের সময় যদি দুর্নীতিকারীর পরিচয়, অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনা করার প্রতক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা না থাকে তাহলে দুর্নীতির মাত্রা এত বেশি হতো না।” জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলোকে আরো বেশি প্রসারিত করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন যত বেশি স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে বলে ড. জামান অভিমত ব্যক্ত করেন।