জুঁই জেসমিন
লেখক- জুঁই জেসমিন

জুঁই জেসমিন :: দিনে দিনে মানুষের গড় আয়ু কি হারে কমছে সত্যিই ভাবনার বাইরে। দাদার বয়স বাপ পাচ্ছে না, আর বাপের বয়স ছেলেমেয়ে পাচ্ছে না। নাতি নাতনির মুখ দেখা তো দূরের কথা সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ করতে না করতেই অল্প বয়সেই জগত থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। কারণ কি? নিশ্চয় একাধিক সমস্যা। তারমধ্যে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল অন্যতম কারণ।

আমি বা আমরা যা খাচ্ছি, কম বেশি সব খাদ্যে ভেজাল আর ভেজাল। তাহলে আমরা সুস্থ থাকবো কি করে? ভেজাল কোথায় নেই বলুনতো ? শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা, ধর্ম সবখানে ভেজালের হাট বাজার। ব্যক্তিস্বার্থের দৌড় এতোটাই চরম সীমানায় পৌঁছেছে যে, সব ক্ষেত্রেই তুমুল এক বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা।

আচ্ছা যারা কেমিকেল মিশ্রিত ভেজাল খাদ্য দ্রব্য বিক্রি করে মানুষকে ঠকাচ্ছেন। আপনারা কি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, আপনার পরিবার কি সম্পূণরুপ সুস্থ? নিশ্চয় বলবেন, না সুস্থ নয়, প্রত্যেকের রিপোর্ট সহ প্রেসক্রিপশনের ফাইল আছে। স্কুল, কলেজ, চাকরী, ব্যবসা, সব কাজ ফেলে ডাক্তারের কাছে প্রতিমাস বা সপ্তাহে ছুটতে হচ্ছে।

আপনি এক লিটার দুধে আটা, জল, পাউডার মিশিয়ে দু লিটার দুধ বানিয়ে বাজারে বিক্রি করেন, আর সে টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করেন। মানুষকে ঠকিয়ে আপনি শুধু ঘরের খাঁটি দুধ টুকু পরিবার মিলে খাচ্ছেন, আর বাকি সব খাদ্য ভেজাল, তাই কি না বলুন ?

অন্যজন যেমন আটাজল মিশানো দুধ খাচ্ছে আপনিও বাকিসব দ্রব্য ভেজাল খাচ্ছেন। আপনি একটা তরমুজ নেন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। তা কেটে দেখেন টকটকে লাল, তবে মিষ্টি মোটেও না যেন জলের সন্দেশ। আর এই লাল মানেই রঙে ডুবা। বাজারে খাসির মাংস কিনতে যান কিংবা খাসির মাথা, সব বকরিই জবাইয়ের পর খাসি হয়ে যায়। কসাইয়েরা খাসির মাংস বলে বকরির মাংস আপনাদের কাছে বিক্রি করছে। তবে ভারী আপসোস। জবাইয়ের পর মোরগ আর মোরগ থাকে না। হয়ে যায় মুরগী। আর বকরি জবাইয়ের পর হয়ে যায় খাসি। হোটেল বা বাসা সব খানেই যদি বলেন, কি খাবেন? মুরগী না খাসি? মুরগী খাসি দুটোই। খেলেন বকরি, আর মোরগ। আর বলতে হচ্ছে খাসি আর মুরগি খেলাম। এই হচ্ছে অবস্থা।

মোটা চাল মেশিনে চিকন করে বাজারে সব চেয়ে দামী চাল হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। আর সব চেয়ে কমদামী চালে মোটা বালি, গুঁড়ি পাথর মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। চিনিতে বালু, চালে পাথর, আর হলুদ, মরিচে ইটের গুড়ো মিশিয়ে তুমুল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়িক বিক্রেতারা। লেপ বালিস আর তোষক খুলে দেখবেন তুলোর বদলে কত গাছগাছালির লতাপাতা ছোবড়া। বাজারে রিন পাওয়ার হোয়াইট নিতে গেলে ঘরে এসে দেখবেন তা রিম পাওয়ার হোয়াইট। মোড়কের রঙ আর ডিজাইন দেখে বুঝার সাধ্য নেই রিন না রিমের প্যাকেট।

জনপ্রিয় বিস্কুট লেকচাস এখন হাইলাক্স হয়ে গেছে। এতো ভেজাল ব্যবহারিক খাদ্য দ্রব্যসমূহকে আমরা মোড়ক দেখেই নাম না পড়ে ক্রয় করি। শিশুরা বেশি অসুস্থ হয় বাইরের কেক, চিপস, রকমারি জুস, চকলেট খেয়ে। একটু ভাবুনতো আপনার বাড়ির পাশে বা স্কুলের রাস্তার ধারে যে দোকানটিতে প্রত্যেকটা জিনিস কেমন রোদের মুখোমুখি ঝুলিয়ে রাখা হয়। চিপস, চানাচুর, কেকের প্যাকেট গুলো রোজ রোজ রোদে ঝলসে যায় আবার ভেজাল সাত পাঁচ উপাদান দিয়ে তো তৈরি করা হয়েছেই। সেই সুস্বাদু বিষ শিশুর মুখে তুলে দিচ্ছি আর বলছি, আমার বাচ্চাটা ভাত খেতেই চায়না। বাইরের খাবার ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা। বাহ ! এই আমরা সন্তানের পিতামাতা। সন্তান যা জেদ ধরে বসে তাই দিতে বাধ্য। সুস্থ অসুস্থতার কথা ভাবা প্রশ্নই আসেনা।

আমরা নিজেকে সব সময় ডাক্তার ও মাস্টার মনে করি। একটু শরীর খারাপ করলেই ওষুধ ফার্মেসী থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক সহ ব্যথার টেবলেট কিনে খাই। আর দোকানদারও প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ দিয়ে দেয়। ভারত, চেন্নাই এ যত কঠিন রোগী ডাক্তারের কাছে যাক না কেন সহজে কোনো এন্টিবায়োটিক দেন না। আর ওষুধ ফার্মেসীগুলোতেও প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ওষুধেই দেন না কাউকে। দেশের মানুষ এক দিকে ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে অপর দিকে এন্টিবায়োটিক খেয়ে শরীরকে শেষ করছি। সিংহভাগ মানুষ দেশের বাইরে যাচ্ছে শুধু মাত্র চিকিৎসার জন্য, পড়ালেখা বা চাকুরীর জন্য নয়। এই ভেজাল দ্রব্য শুধু আয়ু শুষে খাচ্ছে না ফকির তথা নি:স্ব করেই ছাড়ছে। বাপ দাদার বয়স পাওয়া। তাদের মতো দীর্ঘায়ু সুস্বাস্থ্য নিয়ে বাঁচা সত্যিই অসম্ভব।

যা হোক ভেজাল দ্রব্য থেকে পরিত্রাণের উপায় কি ? সব বিক্রেতার জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ দোকান দিতে পারবে না। কোনো কিছু বিক্রি করতে পারবে না। লাভের আশায় ভেজাল দ্রব্য সেবন করা কতটা সমাজের ক্ষতিকর তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে।

প্রতিটি বাজারে সরকারিও ভাবে দ্রব্য সামগ্রী পরীক্ষার জন্য মোবাইলকোটের ব্যবস্থা করতে হবে। অপর দিকে অসংখ্য ওষুধ কোম্পানির পরিবর্তে সীমিত ওষুধ কোম্পানি থাকার ব্যবস্থা নিতে হবে ছাটাইবাছাইয়ের মাধ্যমে। যে ওষুধ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর বা উচ্চ পাওয়ারের, সেই কোম্পানির মালিক রিপ্রেজেন্টিভদের দ্বারা ডাক্তারদের দামী গিফট দিয়ে প্রেসক্রিপশনে তাদের ওষুদের নাম লেখাতে উৎসাহ করেন। যাতে ওষুধ প্রচুর সেল হয়। আর এই জন্য আইনত ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে কোনো ওষুধ কোম্পানিই কোনো ডাক্তারকে কোনো প্রকার গিফট দিতে পারবে না। ওষুধের গুণগত মান দেখে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে ডাক্তারেরা রোগীকে ওষুধ দেবেন। আর সকল ওষুধ ফার্মেসীর মালিক ও কর্মীদের জন্য ৬ মাস অন্তর অন্তর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিতে হবে।

ওষুধের ডেট ফুরিয়ে গেছে সেই ডেট এক্সপেয়ার ওষুধ সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে কম বেশি অনেক ফার্মেসীর কর্মীরা। আর আমরা তা চা নাস্তার মতো রোজ খেয়ে আরও অধিক অসুস্থ হয়ে পড়ি। চিৎকার করে রেডিও, টিভি আর পত্রিকাগুলোতে বড় শিরোনাম করলে সমাধান আসবে না। এ জন্য সুস্থ মস্তিস্কে ভেবে সমাধানের পথ বের করতে হবে। কি ভাবে মানুষ সুস্থ থাকবে?

 

 

লেখক: মানবাধিকার কর্মী, ঠাকুরগাঁও। jui.jesmin306@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here