আজ ঐতিহাসিক ২৭ নভেম্বর। একাত্তরের এই দিনে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে পাক হানাদারদের অতর্কিত হামলায় শহীদ হন ২৭ জন বীরমুক্তিযোদ্ধা। সে দিন পাকহানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আল শামসরা রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় কামান্না গ্রামে। পাখির মত গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করে গ্রামবাসী সহ ২৭ জন মুক্তিপাগল দামাল ছেলেকে।

স্বাধীনতার ৪০ বছরেও অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর। পুর্নবাসন করা হয়নি শহীদ পরিবারগুলোকে। মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এই দিবসটি।

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে কুমার নদের পাড়ে ২৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ৫ টি অবহেলিত গণকবর বুকে ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বহন করে চলেছে কামান্না গ্রাম।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পরপরই মুজিব বাহিনীর ৪২ জন তরুণ শৈলকুপাকে হানাদার মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত থেকে প্রশিক্ষন শেষে কামান্না গ্রামে আসে। তাদের অধিকাংশের বাড়ি পার্শ্ববর্তী মাগুরা জেলার হজিপুর এবং বাকীদের বাড়ি শৈলকুপায়। হজিপুরের আবু বকর ও শৈলকুপার মালিথিয়া গ্রামের আলমগীর ছিল এদের দলনেতা।

কামান্না ছিল শত্রু মুক্ত এলাকা। তাই ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা রাতে গ্রামটির মাধবচন্দ্র ভৌমিকের বাড়ির একটি টিনের ঘরে এবং ১০ জন গ্রামটির সামেনা বেগমের খড়ের দুটি ঘরে অবস্থান নেয়।

এদিকে রাতের আঁধারে স্থানীয় রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের-গোপন তৎপরতায় দ্রুত সংবাদ পৌঁছে যায় ঝিনাইদহ, শৈলকুপা ও মাগুরার পাক আর্মি ক্যাম্পে। তারা ঐ রাতেই চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অস্থায়ী আস্তানা।

শৈলকুপার ধলহরাচন্দ্র ও আবাইপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি প্রধান ঘাঁটি ছিল। দুটি ঘাঁটি থেকেই বিপদ সংকেত জানিয়ে কামান্নায় সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু সতর্কবাণী পৌঁছার আগেই ঘটে যায়  ইতিহাসের নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড।

২৭ নভেম্বর ভোর রাতে চারপাশ ঘিরে ফেলে গর্জে ওঠে হানাদারদের রাইফেল-ষ্টেনগান, এসএলআরসহ অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। টিনের বেড়া ভেদ করে ছুটে আসতে থাকে গুলি।

হঠাৎ আক্রমনে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঘুম ভেঙে হতবিহ্বল ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তার পরেও তারা শক্ত হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। কিন্তু বেশিক্ষন টিকতে না পারায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যে যে ভাবে পারে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে। ফলে কেউবা ঘরের মধ্যে, কেউবা ঘরের বারান্দায় আবার কেউ উঠানে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

রাত গড়িয়ে ভোর হয়, দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ঘরের ছাদে, মেঝেতে, উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ২৭ টি লাশ এক জায়গাতে জড়ো করা হয়। হাজার হাজার মানুষের চোখের জলে ঘটনাস্থল কামান্না হাইস্কুলের পাশেই বয়ে যাওয়া কুমার নদের পাড়ে ৫ টি গণ কবরে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। তাদের সাথে ঐ রাতে  আরও দু’জন গ্রাম বাসি মারা যান। তারা হলেন, রঙ্গ বিবি ও মুক্তিযোদ্ধাদের পথপ্রদর্শক ফনি ভূষণ কুণ্ডু।

ঐদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিশ্ব মিডিয়ায় কামান্না যুদ্ধের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়।

এলাকাবাসী জানান, স্বাধীনতা লাভের পরপরই গঠিত হয় ‘কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতি সংঘ’। দেশ স্বাধীনের মাত্র ১৯ দিন আগে শহীদ হওয়া ২৭ শহীদের রক্তস্নাত পবিত্র স্থানটি সংরক্ষণ বা স্মরন করে রাখার মত কিছুই নির্মিত হয়নি আজও। তবে ২০০৮ সালে গনকবরগুলো ঘেষে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে গ্রামবাসী। কিন্তু তারা ২৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধী স্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মানের দাবি জানান।

ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমাণ্ডার মকবুল হোসেন জানান, এই অবহেলিত শহীদ পরিবারগুলো খুঁজে তাদের পূনর্বাসন সহ তারা যাতে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন।

বাংলার দামাল ছেলেরা অকুতোভয় সাহস নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে সে দিন ঝাপিয়ে পড়ে নিজের জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করে গেছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আজও তাদের কবর স্থান উপেক্ষিত।

স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমান সরকার প্রধান। তাই এ সরকারের কাছে শহীদ পরিবারের দাবিও অনেক। অচিরেই ২৭ শহীদের গণ কবর সংরক্ষণ ও তাদের পরিবারগুলোর পুর্নবাসন করা হোক এমনটিই দাবি এলাকাবাসীর।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/শাহারিয়ার রহমান রকি/ঝিনাইদহ

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here