মো ইসহাক ফারুকী

মো: ইসহাক ফারুকী ::

-‘এই পিচ্চি?

-‘আমার নাম আবু হোসেন।’

-‘ও আবু’…

হোটেলে বেয়ারার কাজ করা ছোট ছেলেটির কাছে চা চাইছে এক লোক। যা তুলে এনেছে শিশুশ্রমকে। শিশুশ্রম আসলে কি? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলে কেউ কেউ আমতা করবেন, কেউবা আবার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা ছেড়ে দিবেন। আমরা নিজের অজান্তেই শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছি শিশুদের। বাসের হেলপার, টেম্পুর কন্ডাকডর, মুটে, কুলি, হোটেলের বেয়ারা থেকে শুরু করে টোকাইয়ের কাজ-সর্বত্র শিশুদের অবাধ বিচরণ; দুঃখজনক হলেও সত্য, শ্রমিক হিসেবে। এই গল্পের শেষ কোথায়? কেউ কেউ ‘গাছে কাঠাল, গোঁফে তেল’ প্রবাদটিকে মনে করে উপহাস করতে পারেন। নাকের তলায়, ঠোটের উপরে গোঁফ না ওঠা মানুষদের নিয়ে এই গল্পটির শেষ দরকার। কারণ, শ্রমে নয়-পাঠ্যক্রমের স্বাদ গ্রহণ করতে, অজানাকে জানতে, বৈষম্যের শিকার না হতেই জন্মেছে প্রতিটি শিশু। কষ্ট লাগে তখনও, যখন করোনাকালেও জীবিকার তাগিদে হোক বা বস্তিতে অসুস্থ বাবা-মা বা বাস্তবতার কষ্ট লাঘব করতেই শিশুরা বিক্রি করছে তাদের ঘাম, শৈশব, শক্তি বিক্রি করছে অর্থের বিনিময়ে।

যথেষ্ট সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে গণ-পরিবহনে। হাত জীবানুমুক্ত করে দিচ্ছে একটি বোতল। বোতলটি হেলপারের হাতে ধরা। হেলপারটি স্প্রেয়ার বা সিঞ্চক দিয়ে ঝরনার মতো জীবানুনাশক ছিটাচ্ছে। ছোট মুক্তোর দানার মতো পানির ফোটা হাতে এসে পড়ছে। বাসে ওঠার আগে দুই হাত কচলিয়ে সকল ছোট ছোট জীবানু পিষে মারছে সব যাত্রী। সিঞ্চকটি ধরে আছে ছোট মুক্তোর মতো ছোট ছোট চোখ দিয়ে পিটপিট করা ১০ বছরের শিশুটি। করোনাকালেও নিজের আনন্দময় শৈশবকে জীবানু ভেবেই পিষে মারছে শিশুটি। সুরক্ষা সবার থাকলেও তার জীবনের সুরক্ষা নেই, নেই তার শৈশবের সুরক্ষা। প্রতিদিন যা আয় করে, তা পরিবারের পিছে খরচ করছে। সাথে সাথে খরচ হয়ে যাচ্ছে তার ভবিষৎ।

আসুন, বিষয়টি ভেবে দেখি। আর ভাবতেই থাকি। ভাবতে ভাবতে হতাশ হয়ে বলি, কি হবে দেশটার? শেষ, সবকিছু শেষ। কিন্তু কত ভাববো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো করে বলতে খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে- আমি আর কত বড় হবো?- সব শেষ হবে। কেউ কথা রাখবে না। রাখেনি যেমন দাদা ঠাকুরের। সবাই কি বোষ্টুমী, নাদের আলী, বাবা ও বরুণার দলের লোক। কেউ কি কথা রাখবে না। ভেবেই যাবে?

কবে দেশ ছেড়ে চলে যাবে শিশুশ্রম; যে শ্রমকে আটকে রাখতে পারেনি করোনা। বস্তির শতচ্ছিন্ন ঘরের ফুটো গলে শিশুশ্রম বেরিয়ে এসেছে দোর্দন্ড-প্রতাপে। শিশুশ্রম কখনো মহাভারতের ঘটোৎকচের মতো রাক্ষুসে হাসি হাসছে, কখনোবা শকুনি মামার মতো শয়তানি হাসি হাসছে। সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নিচ্ছে অগণিত শিশুদের ভবিষ্যৎ।

এবার বাংলাদেশের শিশুশ্রম প্রতিরোধ আইনের দিকে লক্ষা করা যাক, দোকান ও স্থাপনা আইন (১৯৬৫) অনুযায়ী দোকানে বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কমবয়সী শিশুনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তির জন্য শ্রমঘণ্টাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। কারখানা আইন (১৯৬৫) ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৪ বছরের কমবয়সী ব্যক্তিকে নিয়োগদান নিষিদ্ধ করেছে এবং শিশু ও কিশোরের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রবিধান দিয়েছে। এছাড়া এই আইন কোন কারখানায় নারী শ্রমিকদের ৬ বছরের নিচে সন্তানদের লালন-পালনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে। শিশু আইন (১৯৭৪) এবং শিশু বিধি (১৯৭৬) সকল ধরনের আইনগত প্রক্রিয়াকালে শিশুর স্বার্থ রক্ষা করবে। এই আইনে আলাদা কিশোর আদালত গঠনের জন্য বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু অপরাধী যদি যৌথভাবে একই অপরাধ করে থাকে তাহলেও তাদের যৌথ বিচার অনুষ্ঠান করা যাবে না। খনি আইন (১৯২৩) ১৫ বছরের কম বয়সের কোন ব্যক্তিকে কোন খনিতে নিয়োগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ১৫ থেকে ১৭ বছরের যুবকদের নিয়োগ প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শিশু নিয়োগ আইনে (১৯৩৮) বলা হয়েছে যে, রেলওয়ের কয়েকটি কাজে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না এবং রেলওয়ে কারে অথবা বাসে অথবা কোন বন্দরের অধীন এলাকায় শিশুরা কোন দ্রব্য বিক্রয় করতে পারবে না। শিশু (শ্রম অঙ্গীঁকার) আইনে (১৯৩৩) ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর শ্রম চুক্তির অঙ্গীকার অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।

একটু চারপাশে তাকিয়ে দেখুন তো, এই আইনের প্রয়োগ কতটুকু? আপনার শিশুটি হয়তো এমন কাজ করছে না। কিন্তু আপনার আশে-পাশের শিশু? ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ১৪ বছরের নীচে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া যাবে না৷ ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেওয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেওয়া যাবে না৷ আর শিশুদের জন্য ৩৮ ধরনের ঝঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়৷ বিবিএস-এর জরিপেই বলা হয়েছে, ১৭ লাখ শিশু যারা পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে তাদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ এছাড়া ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে যে শিশুরা সপ্তাহে এক ঘণ্টার বেশি কর্মে নিয়োজিত থাকে, তাদের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার৷ সব মিলিয়ে দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমের সাথে যুক্ত আছে৷ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে যে, বিশ্বে ১৫ কোটি ২০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে৷ তাদের আড়াই কোটি শিশুকেই জোর করে কাজা বাধ্য করা হচ্ছে৷

এদিকে করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উল্লেখযোগ্য হারে কমছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নমন্টে অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, আগে যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দিনে স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে নিজেদের পড়ালেখায় ১০ ঘণ্টা ব্যয় করত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র দুই ঘণ্টায়, অর্থাৎ ৮০ শতাংশ সময় কমেছে পড়াশোনার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে যেখানে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দুই দুই ঘণ্টার বেশি আয়মূলক কাজে জড়িত ছিল; এখন তার হার দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। এই তথ্যগুলো গ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। শহরের বস্তি এলাকার চিত্রও মোটামুটি একই রকম।

শিশু শ্রম কি তাহলে সমাজের মূল চাহিদার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল? সরকার চাইছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে কোন শিশু শ্রমিক থাকবে না। তাহলে যে শিশুটি তার পরিবারের দায়ভার বহন করছে, তার পরিবারের অর্থের যোগান দেবে কে? যে শিশুটি নিজের প্রয়োজন মেটাতে মাঠে নেমেছে, তার প্রয়োজন মেটাবে কে? বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। তার অভ্যন্তরে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, জয়িতা ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমি রয়েছে। শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর বলে আলাদা কোন অধিদপ্তর নেই।

শিশুদের অধিকার, শিশু বিষয়ক গবেষণা, শিশুর চাহিদা নিরূপন ও পূরণ, শিশুর জন্য সঠিক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে তাদের বিকাশ, শিশুর মনোবিকাশ, মনোদৈহিক পরিবর্তন, বিশেষ শিশু, প্রাক-শৈশব, দত্তক, শিশু সহায়তা কর্মকান্ড, শিশু বান্ধব পরিবেশ, শিশুর সচেতনতা, শিশু শ্রমের কারণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার, দেশ-সমাজ-বিজ্ঞান চেতনা সৃষ্টি, শিশুদের অংশগ্রহণে আনন্দ-উৎসব-মেলার আয়োজন, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু-শ্রম বন্ধ, বিকল্প ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক মুক্তিতে করণীয়, ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য করণীয়সহ নানাবিধ বিষয় তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের। যেখানে শিশুদের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপের মাধ্যমে ব্যক্তিগত-সরকারি-বেসরকারিভাবে শিশুবান্ধব কর্মকান্ড পরিচালনা করা যাবে। তাই অধিদপ্তর দিয়েই সূত্রপাত হোক শিশুদের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচনের।

 

 

 

লেখক: সাংবাদিক, পরিবেশ কর্মী, গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিশ্লেষক। ifaruquee@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here