শিশুসাহিত্যের গুরু আমীরুল ইসলাম’র মূল্যায়নে মঈন মুরসালিন একজন সফল ছড়াকবি

আমীরুল ইসলাম

 

২০০৬ বা ২০০৭ সাল। বাংলা একাডেমির ভেতরে তখন বইমেলা। মাদ্রাসার ছাত্রদের মতো পোশাক পরা একজন তরুণের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। মুখে অল্প দাড়ি। পাজামা পাঞ্জাবি পরনে। তখন খাবারের দোকানগুলো বসতো বাংলা একাডেমির এনামুল হক ভবনের ওখানে। ভবনটি তখন তৈরি হয়নি। সেই তরুণ ছোটদের জন্য একটা পত্রিকা প্রকাশ করে। নিজেই সম্পাদক, নিজেই প্রকাশক। ছেলেটি আমার সর্ম্পকে তেমন কিছুই জানে না। আমি ছড়া টরা লিখি টিকি এইটুকুই। পত্রিকাটির নাম কানামাছি দেখে ভালোই লাগলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকাটি পড়ে ফেললাম। কিছু সমালোচনা করলাম। পত্রিকাটি কি করে আরও ভালো হবে সেই বিষয়ে মতামত দিলাম। ছেলেটি মন দিয়ে শুনলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, সে আমার কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করলো না। আমার বয়সও তখন কম। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা আছে। অই মিয়া হুজুর, তুমি তো আমারে চিনো না। আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত ‘আসন্ন’ এর সম্পাদক। আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর দেশে প্রথম চার রঙের কিশোরদের দুইপাতা (দৈনিক বাংলার) সম্পাদনা করেছি। আমগো মতামতের ভেলু দিও। ছেলেটির মুখে মৃদু হাসি। সে বাতচিত- করল না। হাসি মুখে সে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তার কোনো জড়তা নেই। দ্বিধা নেই। মাদ্রাসা থেকে সে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে। তার কোনো সংকোচ নেই। তার কোনো পরোয়া নেই। সে উদার মানসিকতার মানুষ। প্রথম দিনেই তার নামটা আমার মনে গেঁথে গেলো। তার নাম মঈন মুরসালিন। কিছু দিনের মধ্যে মঈনের স্বরূপ উন্মোচিত হলো। মঈন পত্রিকা প্রকাশ করে। মঈন ছড়া লেখে। মঈন বই প্রকাশ করে। মঈন নানা ধরণের সাংগঠনিক তৎপরতায় ব্যস্ত থাকে। মঈন’রা বিশাল লেখক বন্ধু গোষ্ঠী তৈরি করেছে। দেশ জুড়ে মঈনদের নেটওয়ার্ক। দূর থেকে এইসব দেখি। ওদের কাজকর্মের খোঁজ খবর রাখি। তারপর একদিন ওদের সাথে বন্ধুত্বও তৈরি হলো। হাসান রাউফুন, নাফে নজরুল, তাহমীদ আবরার, রুবেল হাবিব, ইফতেখার শিবলি, হালিম নজরুল, আহমেদ জাকির, আহমাদ স্বাধীন, ইমরান পরশ, সিরাজীয়া পারভেজ, শামীম হাসনাইন আরো অনেকেই মিলে ওরা একটা গোষ্ঠী। যতো দিন যায় ওদের সাথে ক্রমে ক্রমে আন্তরিকতা বাড়ে। ওদের সাথে নিয়ে আমার বাসায় কতো আড্ডা হয়েছে। সেখানে বয়সের কোনে ভেদ মানা হয় না। সেখানে পরস্পর হৃদয় বিনিময়টাই বড় কথা। মঈনরা দল বেঁধে অনেক ধরনের কাজ করে। আজ মঈন মুরসালিন বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রকাশকও বটে। মঈন হৃদয়বান মানুষ। মানুষের উপকার করার জন্য সে উন্মুখ হয়ে থাকে। সবাইকে নিয়ে সে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। সম্ভবত ধর্মীয় পরিবেশে সে বড় হয়েছে বলে তার এই মানবিকতা। বাবা বড় মাওলানা। মঈনের ভাইয়েরা ইসলামী সুশিক্ষিত। মঈন আলাদা পথে হেঁটেছে। এই যে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতা, এটাই মঈনকে বড় করেছে। মঈনের অগ্রযাত্রা অনেক দূর। সে অপ্রতিরোধ্য। ওর চরিত্রে নানা ধরনের সৎ গুণের সমাবেশ আছে। মঈনকে পছন্দ না করে উপায় নাই। মঈনকে ভালোবাসতেই হবে। আমি মঈনের অনুরাগী। ওর কাজকর্মগুলো আমি পছন্দ করি। মঈনকে ভালোবাসি। আর সর্বোপরি লেখক মঈনকে আমার ভালোবাসা। কারণ মঈন ভালো লেখে। ভালো লিখতে চায়।

দুই ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে মঈন মুরসালিন এর ১০০ছড়া। শাদামাটা মুদ্রণ। কবিতার মতো ছড়াগুলো সহজ। ভেতরে অকারণে কোনো ইলাস্ট্রেশন নেই। অনেক সময় শিল্পীর আঁকা ছবি হয়তো ছড়ার চরিত্র গুণকে ক্ষুণ্ন করে। ছড়াগুলো ছবিময় হলেই কেবল মাত্র সুশোভিত ছবি দিয়ে ছড়ার বই প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু যে কোনো ছড়ার বই ছবি সমৃদ্ধ করলে ছড়াকে কেমন যেনো দেউলিয়া করে দেয়। মঈন মুরসালিন সে কারনে বইয়ের মধ্যে অকারণ ইলাস্ট্রেশন সন্নিবেশিত করেনি। মঈন একারণে সবার ধন্যবাদ পাবে। মঈন চেনা পথে ছড়া লিখে থাকে। কিছুকিছু ছড়া নিরীা মূলক। মঈনের সমাজ সচেতন ছড়া অনেক। এর পাশাপাশি মঈন হাস্যরসাত্মক ছড়াও লিখেছে প্রচুর। এসব ছড়ার কোথাও কোথাও পূর্বসুরীদের ছন্দ ও বিষয় ভাবনা উঠে আসে। মঈনের ছন্দ নির্ভুল। গ্রন্থিত অধিকাংশ ছড়া স্বরবৃত্তে লেখা। মঈনের হাতে স্বরবৃত্ত প্রাণ পায়। মঈন নানা বিষয় নিয়ে ছড়া লেখে। ১০০ছড়ায় তার সৃজনশীলতার অনেক নমুনা পাওয়া যায়। নিঃস্ব ও দরিদ্র মানুষের জন্য তার সমবেদনা আছে। সে এর প্রতিকার চায়। কবি আসাদ চৌধুরী ১০০ ছড়ার ভূমিকায় লিখেছেন: বাংলাদেশের নিসর্গ বিশেষ করে পাখি, ফুল, নদী, উদার প্রান্তর, আকাশ, বৃষ্টি তার প্রিয় বিষয়। এই পরিবেশ যে লোভী মানুষের কাছে পড়ে বিপন্ন হচ্ছে সেটাও তিনি গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছেন। শিশু মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে মনোযোগী না হলে এই রকম ছবি আঁকা সম্ভব নয়, মানতেই হবে। কবি আসাদ চৌধুরীর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন মঈনকে নিয়ে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন শুধু শিশু কিশোররাই নয়। তাদের অভিবাকরাও বইটি পাঠ করবেন। কবি আসাদ চৌধুরীর সুস্পষ্ট বয়ান তো মঈনের জন্য রাজতিলক প্রাপ্তি। বহু ফরমায়েশের চেয়েও কবি আসাদ চৌধুরীর লিখিত ভূমিকা অনেক স্বীকৃতি বলে মনে করি। ছড়াকার হিসেবে মঈন সিদ্ধহস্ত। প্রকাশনা ও সংগঠন নিয়ে মঈনের পরিচয় এতো বিস্তৃত হয়ে উঠেছে যে, লেখক মঈনকে আমরা অনেক সময় উপো করি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে মঈনের ছড়ার অনুরাগী পাঠক। মঈন কবিতাও লেখে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে। তার কবিতা মনোযো দিয়ে পড়া হয়নি। মঈন গদ্যও লেখে। আমি সে সব নিয়ে উচ্ছ্বসিত নই। তবে মঈনের ছড়া আমাকে টানে। ছড়াকার মঈন মুরসালিন নিঃসন্দেহে তার প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য ছড়াকবি। মঈনের ছড়ায় অনেক বৈচিত্র্য আছে। নানা বিষয়কে সে ছন্দ-সুরে ধারণ করে। শিশুতোষ ছড়া, সমাজ সচেতন ছড়া, প্রকৃতির ছড়া, মুক্তিযুদ্ধের ছড়া- সবখানেই মঈনের বর্ণাঢ্য উপস্থিতি। মঈন অনুসন্ধিৎসু। ভালো লেখার জন্য মঈন সদাসচেষ্ট। এই সৎ প্রচেষ্টাই মঈনকে আরো ভালো লিখতে সহয়াতা করবে। মঈনের ছড়া পড়ে আবারও মুগ্ধ হতে থাকবো। কারণ মঈন লেখার মধ্যে সৎ থাকে। উপর চালাকি করে না। মঈন দলবাজি করে না। শর্টকাট পথে খ্যাতি অর্জন করতে চায় না। প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয় না। সবচেয়ে বড় কথা- মঈন মুরসালিনের বিবেচনা বোধ তীব্র। সে নিজেকে চেনে। সে নিজেকে অকারণ উচ্চতায় তুলে ধরে না। নিজের সর্ম্পকে হাস্যকর বিশেষণ আরোপ করে না। আর দাবি করে না সে একজন সফল ছড়াকবি। এই জন্যই সৎ ও নিষ্ঠাবান লেখকরা মঈনকে পছন্দ করে। ভালোবাসে। মঈনকে ভালো না বেসে উপায় কি?

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here