শিশুর নিরাপদ আশ্রয় কোথায়?

রহিমা আক্তার মৌ :: ” লোভ দেখানো, ধর্ষণের চেষ্টা, হত্যা করা, অপরাধ কয়টা”

খবরটা পড়েই থমকে যাই। লিপিস্টিকের লোভ দেখিয়ে চার/ পাঁচ বছর বয়সি দুই শিশুকে বাসার ভেতর ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় মুখে গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাদেরকে। প্রিয় পাঠক এই মুহূর্তে আমরা সবাই একটিবার নিজেদের ছোটবেলায় কিংবা নিজেদের বোনের বা কন্যা সন্তানের ছোটবেলার কথা মনে করি। প্রায় সব শিশুর এই (চার/পাঁচ) বছর বয়সটা প্রায় একই রকম হয়। যখনি হাতের কাছে সাজুগুজু করার কিছু দেখবো তখনিই সাজুগুজু করতে চাইবো। কেউ দিতে চাইলেই হাত পেতে নিবো। অথচ সেই সাজুগুজু করার সামগ্রি লিপিস্টিকের লোভ দেখিয়ে দুইশিশুকে ঘরে আনে। ধর্ষণের চেষ্টা করে। হত্যা করে। ঘটনা জানাজানির পরই পালিয়ে যায় প্রধান অভিযুক্ত গোলাম মোস্তফা ও আজিজুল বাওয়ানী। পরে যাত্রাবাড়ির ভাঙ্গা প্রেস এলাকা থেকে মোস্তফাকে এবং তার দেয়া তথ্যে ডেমরার কাউন্সিল ব্রিজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আজিজুলকে।

প্রিয় পাঠক এই ঘটনা হয়তো পত্রিকার পাতায় কয়েকদিন থাকবে, টিভি নিউজ হবে দিন চারেক। তদন্ত করার লোক ঠিক হনে, তদন্ত হবে, রিপোর্ট জমা হবে। সাক্ষীর অভাবে আইনের ফাঁকে আসামি খালাস পাবে। কারণ সাক্ষী ছাড়া বিচার হবে কি করে। বিচারক রায় দিবে কি করে। খুব অবাক হয়েছি সেইদিন, যেইদিন শুনেছি ধর্ষণ হবার সাক্ষী না থাকলে বিচার করা সম্ভব নয়। অবাক হবার পর হেঁসেছি অনেক, এই ভেবে যে ধর্ষক নাকী সাক্ষী রেখেই ধর্ষণ করে। শুধু কি তাই? ধর্ষণের আলামত নিয়ে আসতে হবে আইনের কাছে। আইনের লোকেরা পরীক্ষা করে দেখে আলামত পেলেই তবে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে, আর আসামী ধরা সে তো অনেক পরের কথা। এই ঘটনায় কয়টি অপরাধ হয়েছে তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
১- শিশুদের লোভ দেখিয়ে ঘরে আনা হয়েছে।
২- ধর্ষণের চেষ্টা করেছে।
৩- হত্যা করেছে।

এই তিনটি অপরাধের কারণে কি কি শাস্তি হতে পারে তা আমাদের জানা না থাকলেও নিশ্চই আইনের লোকেদের জানা আছে, যেই আইনের লোকেরাই আসামীদের মুক্তি করে আনবে কাঠগড়া থেকে।

গত ৭ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার রাতে রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়ার শাহজালাল রোডের নাসিমা ভিলা নামের বাড়ির নিচতলার কক্ষ থেকে নুসরাত জাহান ও ফারিয়া আক্তার নামে চার/পাঁচ বছরের দুই কন্যাশিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত শিশুরা হলো, ডেমরার শাহজালাল রোডের এসি গলির মৃত কালাম মিয়ার বাড়ীর ভড়াটিয়া পটুয়াখালীর দশমিনা থানার আলীপুরা গ্রামের মো. ফরিদুল ইসলামের মেয়ে ফারিয়া আক্তার দোলা ও ওই এলাকার রশিদের বাড়ীর ভাড়াটিয়া ঝালকাঠির ঝালকাঠি থানার বাউকান্দি গ্রামের পলাশের মেয়ে নুসরাত জাহান। তাদের দুজনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন শনাক্ত করা হয়েছে। সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদের লাশ রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কোনাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক এএসআই আবু হায়াত সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিশু দু’টি দুপুর থেকেই নিখোঁজ ছিল। তাদের খোঁজ চেয়ে মাইকিংও করা হয়। পরে ওই বাড়ির নিচতলায় দু’জনের মরদেহ খুঁজে পাওয়া গেলে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। ডেমরা থানা পুলিশও এসেছে। শিশু দু’টির মরদেহে আঘাত দেখতে পেয়েছি।’

ডেমরা থানার পরিদর্শক নূরে আলম সিদ্দীক বলেন, ‘রাত পৌনে ১০টার দিকে আবুলের বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষ থেকে মেয়ে শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। দুজনের লাশ খাটের নিচে একটির উপর আরেকটি রাখা ছিল। সকাল থেকে শিশু দুটি নিখোঁজ ছিল। তাদের জন্য মাইকিংও করা হয়। যার বাসায় লাশ পাওয়া গেছে, সেই গৃহকর্তা মোস্তফা পলাতক। তবে কীভাবে শিশু দুটি মারা গেল, তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’

মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই শিশুকে হত্যার ঘটনায় মূল আসামিসহ অভিযুক্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মূল অভিযুক্ত গোলাম মোস্তফা ও তার চাচাতো ভাই আজিজুল।

৯ জানুয়ারি বুধবার টিভি নিউজে ও অনলাইনে জানতে পারি, ‘অপরাধীরা হত্যার কথা স্বীকার করে, আরো বলে, ধর্ষণের জন্যেই তারা শিশু দুটিকে লিপিস্টিক দেয়ার লোভ দেখিয়ে ঘরে আনে, এরপর উচ্চস্বরে গান চালিয়ে তারা দুই শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ সময় চিৎকার করলে তাদের মুখে গামছা দিয়ে চেপে ধরলে দু’জনই মারা যায়। অপরাধীরা মূলত ধর্ষণ করার উদ্দেশেই শিশুদেরকে ডেকে নেয়।

পুলিশ জানায়, সিরামিক মিস্ত্রি মোস্তফার স্ত্রী একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে। ঘটনার দিন স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে দুই শিশুকে বাসায় ডেকে নেয় তারা। চেষ্টা করে ধর্ষণের। শিশুরা চিৎকার করলে উচ্চস্বরে গান চালিয়ে দেয় এবং গামছা দিয়ে মুখ চেপে ধরে। মোস্তফা প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ঘরে অবস্থান করে। মোস্তফার স্ত্রী যখন বাসায় আসে, তখন তার স্বামীকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখেন এবং বাসায় ছোট বাচ্চাদের স্যান্ডেল দেখতে পান। অভিযুক্ত দুজনই মাদকাসক্ত। ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা সেবনের আলামতও উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া মোস্তফার নামে আগেও মামলা রয়েছে যাত্রাবাড়ি থানায়।ওই বাসা থেকে ইয়াবা সেবনের আলামত পাওয়া গেছে। বাচ্চাদের পরা স্যান্ডেল, যে গামছা দিয়ে মারা হয়েছে সেটা এবং সেই ক্যাসেটও উদ্ধার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের বহু ঘটনা ঘটছে কিন্তু তার বিচার এবং শাস্তি হচ্ছে খুবই কম। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। এছাড়া ধর্ষণের বিচার পেতেও নারীকে পদে পদে হয়রানি আর অবমাননার শিকার হতে হয়। ধর্ষণের শিকার নারীকে বার বার ঘটনার বিবরণ দেয়া এবং নানান প্রশ্নের মুখে বিব্রত হতে হয়। আর ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করলে তো কথাই নেই।

বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যে জানা যায় ২০১৬ সাল এবং ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ হাজার ৮শর বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। দেশে ধষর্ণের মামলায় বিচারের হার নিয়ে অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি ধর্ষণ মামলায় মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশের শেষ পর্যন্ত সাজা হয়। প্রত্যেকটা জায়গায় একজন মহিলাকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে অথবা একটা কিশোরীকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে সে ধর্ষিত হয়েছে।” (তথ্যসূত্র — বিবিসি নিউজ বাংলা, ১৮ মে ২০১৭)

ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডাক্তার বিলকিস বেগম বলেন, শারীরিক পরীক্ষা যথাসময়ে না হলে ধর্ষণ প্রমাণ ও বিচার পাওয়া কঠিন। আইনি লড়াইয়ের জন্য এই যে সার্টিফিকেটটা খুবই দরকার। এই সার্টিফিকেট না হলে কোনো বিচারই হবে না। ওরা আসতেই দেরি করে ফেলে অনেক সময়। ফাইন্ডিংস আমরা ঠিকমতো পাইনা। ঘটনা ওরা স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, সময়টা কিল করে ফেলে। লিডাররা বসে সাতদিন পনেরদিন পার করে ফেলে আমরা ফাইন্ডিংস পাই না।”

মনোরোগ চিকিৎসক, আইনজীবী ও শিশু অধিকারকর্মীদের মতে, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। পাশাপাশি ধারণা করা হয়, এরা অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারবে না। তাঁরা বলছেন, এটা প্রতিরোধ করার জন্য দরকার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। শিশু ধর্ষণ এর বিচার ব্যবস্থা নিয়ে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীর পার পাওয়ার সুযোগ নেই। আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা হবে। তবে শিশুরা সব সময় ঘটনার কথা বলতে পারে না, সাক্ষীও থাকে না। মামলা দুর্বল হয়। ফলে অভিভাবককে সন্তান পালনে আরও সচেতন ও মনোযোগী হতে হবে।’

‘মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৬ সালে মোট ধর্ষণের ঘটনা ৭২৪টি। এর মধ্যে ৩০৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫৭টি শিশুর বয়স ১২ বছরের কম। ৬ বছরের নিচে আছে ৪৬টি শিশু। আটটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে। শিশুবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) ১০টি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বছরওয়ারি পরিসংখ্যান রাখে।

বিএসএফের তথ্যমতে, একই বছরের প্রথম ১১ মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ৪ শতাধিক। যার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৪টি শিশু। ধর্ষণের শিকার অটিস্টিক শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য, ৩৮টি। ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ শিশুর বয়স ৪ থেকে ৯। ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫২১টি।’ –( তথ্যসূত্র, প্রথম আলো)

ছোট শিশুরা বেশির ভাগ সময় কিছুই বুঝতে পারে না। ফলে অপরাধীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে নিশ্চিন্তে অপরাধ করে। রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়ায়ও তাই হয়েছে। নিজেদের জীবন দিয়ে দুইশিশু এই পৃথিবীকে জানিয়ে গেলো ওরা ধর্ষিত হয়নি, ওরা হত্যার শিকার হয়েছে। ওরা জানেনা ওদের সাথে কতগুলো অপরাধ হয়েছে, ওরা জানেনা এর বিচার কি হবে স্বাধীন বাংলাদেশের আইনের ঘরে !

 

 

 

লেখক: সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।   rbabygolpo710@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here