মুজাহিদুল ইসলাম সোহেল, নোয়াখালী প্রতিনিধি: একাত্তরের সাতই মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভায় উপস্থিত ছিলেন টগবগে তরুণ এ বি এম ফজলুল হক বাদল। সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনেছিলেন নিজ কানে। আঁচ করতে পেরেছিলেন সশস্ত্র যুদ্ধ অত্যাসন্ন। ফিরে আসেন নিজ এলাকা নোয়াখালীতে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নেন। প্রশিক্ষণ নেন ভারতের আসামে। দেশে ফিরে নোয়াখালী শত্রুমুক্ত করতে পরিচালনা করেন বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন। কিন্তু তালমোহাম্মদ হাটযুদ্ধে শহীদ হন সহযোদ্ধা কমান্ডার অহিদুর রহমান অদু। এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হারানোর ভার বইতে পারছেন না ফজলুল হক। শহীদ অদুর জন্য এখনো কাঁদেন তিনি।

এ বি এম ফজলুল হক নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার পৌর এলাকার শ্রীপুর গ্রামের মরহুম আবদুল খালেক মিয়ার দ্বিতীয় ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নোয়াখালী জেলা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্কুলশিক্ষক স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার ৬৮ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।

তাঁর আক্ষেপ, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন সেই উদ্দেশ্য এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। সর্বস্তরে সুশাসনের অভাব রয়েছে। তবে ফজলুল হকের আশা, শিগগিরই কেটে যাবে অন্ধকার। উদয় হবে স্বপ্নের সোনালি সূর্য।

মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নোয়াখালী সদর উপজেলা কমান্ডার মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন আমাদের টিম লিডার। আমরা একসঙ্গে ভারতের আসাম গিয়েছিলাম প্রশিক্ষণ নিতে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তাঁর নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন চালাই আমরা।’

তাঁকে অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্যক্তিজীবনেও ফজলুল হক একজন সৎ ও পরোপকারী মানুষ। যুদ্ধের ময়দানে তাঁর মতো যোদ্ধা থাকায় দেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম মাস হানাদাররা নোয়াখালীতে ঢুকতে পারেনি। এদের সঙ্গে সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে ৪ এপ্রিল নোয়াখালীর প্রবেশমুখ লাকসামের উত্তরে বাগমারায় প্রথম সংঘর্ষ হয়। এর পর ১০ এপ্রিল লাকসামে সম্মুখযুদ্ধ হয়। ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা নোয়াখালীতে ঢুকে পড়ার আগেই স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। যাঁরা যুদ্ধে যেতে তৈরি হয়েছিলেন, তাঁদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেখানে। প্রশিক্ষণে এ বি এম ফজলুল হক বাদলও অংশ নেন। আর অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করেন।

ওই সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নোয়াখালী শহর শাখার আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন এ বি এম ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমরা প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ি তুলি নোয়াখালীতে।’

এর পর ভারতে গিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন ফজলুল হক। জেলা কমান্ডার মাহমুদুর রহমান বেলায়েত কর্তৃক মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) সদর থানার দলপ্রধান (কম্পানি কমান্ডার) নিযুক্ত হন তিনি। এর পর তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন চলে।

‘তালমোহাম্মদ হাটযুদ্ধে আমাদের হাতে অনেক শত্রু সৈন্য নিহত হয়। ওই অপারেশনের পরিকল্পনা করেছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর গুলিবর্ষণ শুরু করেছিলাম আমি, ইকবাল ও গিয়াস। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওই যুদ্ধে আমাদের কমান্ডার অহিদুর রহমান অদু শহীদ হন। বিজয়ের মাত্র কিছুদিন আগে ২০ নভেম্বর সবার প্রিয় স্বাধীনতার সূর্যসন্তান কমান্ডার অদু ভাইকে হারিয়েছিলাম আমরা। যা এখনো আমাদের কাঁদায়। সেই স্মৃতি কখনো ভুলব না।’-বলেন ফজলুল হক। তিনি জানান, ৬ ডিসেম্বর রেডিও আকাশবাণীর দুটার খবরে জানা যায়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত। এই খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বিএলএফ জেলা কমান্ডার মাহমুদুর রহমান বেলায়েতের নির্দেশে রাতে নোয়াখালী শহর মুক্ত করার জন্য সবাই প্রস্তুতি নেন। ওই রাতে সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়।

‘আমরা নাহার কটেজ আক্রমণ করে শত্রুমুক্ত করি। আরেক দল মাইজদি কোর্ট স্টেশনের রাজাকার ক্যাম্প হানাদারমুক্ত করে। অন্য দল দত্তেরহাট রাজাকার ক্যাম্প মুক্ত করে। সফল এসব অপারেশন শেসে সবাই একসঙ্গে পিটিআই অভিমুখে যাত্রা করি। ৭ ডিসেম্বর বেলা দুটার দিকে পিটিআইর হানাদার ক্যাম্পের পতন ঘটে।’-এভাবেই নোয়াখালী শহর শত্রুমুক্ত হওয়ার গল্প শোনান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

‘নোয়াখালী শহর ৭ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলেও পুরো দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত আমাদের মাউন্টেন ব্যাটালিয়ানের সদস্য সাইফুল আযম জাহাঙ্গীর, মমতাজুল করিম বাচ্চু, সামছু উদ্দিন, আজাদ ও জীবন দাসসহ অনেকে ১৬ ডিসেম্বরের পরও যুদ্ধ চালিয়ে যান।’-যোগ করেন তিনি।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন ও অসহায় অবস্থায় থাকাটা নোয়াখালীর সেই সময়কার তরুণ এ বি এম ফজলুল হক বাদলের মনে রেখাপাত করেছিল। এই অবস্থায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার পর ফজলুল হকসহ আরও কয়েকজন তরুণ নোয়াখালীতে ছয় দফা আন্দোলন, পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ওই আন্দোলনের কারণে তিনি দুই বার গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন। ১৯৭০ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’ আঘাত হানার পর উদ্ধার ও পুনর্বাসন কাজেও তিনি নিয়োজিত ছিলেন।

এর পর শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে তিনি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জনসভায়, যোগ দেন।

স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৬ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত আমার সঙ্গে রাজপথে ছিলেন মোস্তফা কামাল, ইউছুপ ভূঁইয়া, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লা, সামছুল মতিন, আবদুল মতিন, আবদুল ওহাব, শাহজাহান, এমরান মোহাম্মদ আলী, ফয়েজ প্রাণধন, জিএস কাশেম প্রমুখ বীর মুক্তিযোদ্ধা।’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here