স্টাফ রিপোর্টার :: চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভার আগে মিছিলে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় পাঁচ পুলিশকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ইসমাঈল হোসেন সোমবার চার আসামির উপস্থিতিতে এই মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন- কোতোয়ালি থানার সেই সময়ের প্যাট্রল ইন্সপেক্টর জেসি (গোবিন্দ চন্দ্র) মণ্ডল, কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, মো. আবদুল্লাহ এবং মমতাজ উদ্দিন। এর মধ্যে জেসি মণ্ডল পালাতক রয়েছেন।

তবে বিচার চলাকালে মামলার প্রধান আসামি তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কনস্টেবল আবদুস সালাম ও কনস্টেবল বশির আহমদ মারা যাওয়ায় তাদের অব্যাহিত দেয়া হয়েছে।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির ওই ঘটনায় যে ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন তারা হলেন- হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম. স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও মো. শাহাদাত। ঘটনাস্থলের অদূরেই নিহতদের স্মরণে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

রাষ্ট্রপক্ষে দীর্ঘদিন মামলাটি পরিচালনা করেন সিনিয়র আইনজীবী স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস, সাধন কুমার ধর, কামাল উদ্দিন আহমদ, মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ আওয়ামীপন্থী অনেক আইনজীবী। রায় ঘোষণার পর অ্যাডভোকেট স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, দেরিতে হলেও মামলার রায় হয়েছে।

আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এতে আমরা সন্তুষ্ট। অচিরেই এ রায়ের বাস্তবায়ন চাই। তবে মামলার বাদী অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদা বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় রায় দেখে যেতে পারেননি।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন সরকারবিরোধী একটি সমাবেশের ডাক দেয়া হয় লালদীঘি মাঠে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ট্রাকবহর নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল লালদীঘি মাঠে যাচ্ছিল।

মিছিলটি পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে পৌঁছলে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে নির্বিচারে গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশ।

এতে শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ পথচারীসহ ২৪ জন মারা যান। আহত হন অন্তত ২শ’ জন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলসহ আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা।

আবদুল মান্নান নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মী ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। পুলিশের হাত থেকে গ্রেফতার এড়াতে তিনি গোপনে চিকিৎসা নেন। ঘটনার পর তার মৃত্যু হয়েছে ভেবে পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে গায়েবানা জানাজাও পড়ানো হয়েছিল। এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও ছিলেন তিনি।

রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল মান্নান। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি কলেজ থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। কোতোয়ালি মোড় থেকে ট্রাকবহরে করে এবং হেঁটে হাজার হাজার মানুষের মিছিল লালদীঘি মাঠের সমাবেশে যাচ্ছিল।

মিছিলটি পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতারা ট্রাক থেকে শেখ হাসিনাকে নামিয়ে নিরাপদে সরিয়ে নিলেও অনেকে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলিতে আমি নিজেও আহত হই। পরে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হই।

নির্মম ওই গণহত্যার ঘটনায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আবদুল মান্নান বলেন, সেদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও মারা যেতে পারতেন। কিন্তু হায়াত ছিল বলেই তিনি বেঁচে ছিলেন। দেরিতে হলেও এই মামলার রায় হওয়ায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

যে কারণে রায় পেতে বিলম্ব : আদালত ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৮ সালে এ গণহত্যার ঘটনা ঘটলেও কেউ মামলা করার সাহস পায়নি। ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদা বাদী হয়ে আদালতে মামলাটি করলেও তদন্ত হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। ঘটনার সময় সিএমপির কমিশনার থাকা মির্জা রকিবুল হুদা ও কোতোয়ালি জোনের পিআই জেসি মণ্ডলসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে ১৯৯৮ সালে চার্জশিট দেয়া হয়।

২০০১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আবারও এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। তাছাড়া এ মামলায় ১৬৮ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করাও ছিল কঠিন। মামলার বিচার চলাকালে বাদী অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদার মৃত্যু হয়। প্রধান আসামি মির্জা রকিবুল হুদাসহ মারা যান আরও তিন আসামি। মারা যান মামলায় চার্জশিট প্রদানকারী সিআইডি কর্মকর্তা এমএ কাদের খানও।

গত ১৪ জানুয়ারি ৫৩তম সাক্ষী আইনজীবী শম্ভুনাথ নন্দীর সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওইদিন আদালত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ১৯ জানুয়ারি দিন ঠিক করেন।

রোববার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন শেষে পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। পরে আদালত আসামি পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য সোমবার দিন রেখেছিলেন। কিন্তু আসামি পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন না করায় এদিনই আদালত রায় ঘোষণা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here