মহানন্দ অধিকারী মিন্টু, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি ::

মধুমাস ঋতুরাজ বসন্ত আগমনী বার্তা নিয়ে আসে আম্র মুকুল। লবাণাক্ত এ জনপদ খুলনার পাইকগাছায় কিছু বাড়ি ও আমবাগান স্বর্ণালী মুকুলের ম-ম গন্ধে মুখরিত চারপাশ। বাতাসে মুকুলের ম-ম সুবাস। মৌমাছি দল বেঁধে ভিড়ছে স্বর্ণালী মুকুলে। সু-মিষ্ট সৌরভ আন্দোলিত হচ্ছে পথচারীসহ আমচাষীর মন। লবণাক্তার আগ্রাসনে অন্যান্য সবুজ বৃক্ষরাজির ন্যায় হ্রাস পেয়েছে জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ।

উপজেলার অল্প কিছু জায়গায় লবণপানি আগ্রাসন ঠেলে আম গাছ টিকে আছে। এ বছর আশানুরূপ মুকুল হয়নি, তার পরেও আমচাষি ও মালিকরা বাগান পরিচর্যা নিয়ে ব্যাস্ত। মুকুল আশার আগে থেকেই গাছের পরিচর্যা করে আসছেন। যাতে করে গাছে মুকুল বা গুটি বাঁধার সময় কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। উপকূলীয় এলাকায় চলতি বছর অনেক দেরিতে মুকুল আসছে। অধিকাংশ গাছের মুকুল ভালো হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে, ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন গদাইপুর, হরিঢালী, কপিলমুনি, রাড়ুলী ও পৌরসভা ছাড়া বাকি ইউয়িনগুলোতে সীমিত আমের গাছ রয়েছে। উপজেলায় ৫৮৫ হেক্টর জমিতে আম গাছ রয়েছে। গাছের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। কিছু কিছু পরিকল্পিত আম বাগান রয়েছে। এসব বাগানে সর্বনিন্ম ১০টি গাছ রয়েছে। ৫শতক, ১০শতক, ১ বিঘা ও ৩ বিঘা পর্যন্ত আমের বাগান রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নে ছড়ানো ছিটানো আম গাছ আছে। এসব বাগানের ৮০-৯০ ভাগ গাছে মুকুল ধরেছে। তবে গাছের দুই-একটি ডালে মুকুল বের হয়েছে। আর বাকী ডালের পল্লবে মুকুল হয়নি। অনেক গাছে কোনো মুকুলই বের হয়নি। ১০-১৫ ভাগ আম গাছে কোনো মুকুল বের হয়নি। তবে এখনো সময় আছে আরো কিছু গাছে মুকুল বের হতে পারে এমন আশা করছে আম চাষী ও বাগান মালিকরা।

কৃষি অফিস আশা করছে, আম বাগান থেকে চলতি মৌসুমে ৫ হাজার ৮শত মেট্রিক টন আমের ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও বাগান মালিক, কৃষিবিদ, আমচাষিরাও আশা করছেন বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উপজেলায় আমের ফলন আশানুরূপ হবে। উপজেলায় মল্লিকা, চুষা, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, লতা, বারি ৪, আম্রপলি, গোপালভোগ সহ অন্যান্য জাতের আম চাষ হয়। সহকারি কৃষি কর্মকর্তা ও বাগান মালিকরা জানান, নিয়মিত পরিচর্যা, গাছের গোড়ায় বাঁধ দিয়ে পানি সেচের কারণে সব বাগানে গাছগুলো নিয়মিত খাদ্য পাচ্ছে। ফলে আশানুরূপ ফলন বাড়ছে।

উপজেলার কপিলমুনি, গদাইপুর, হরিঢালী, রাড়ুলী, পৌরসভা, চাঁদখালীসহ বিভিন্ন এলাকা আম বাগানের গাছে মুকুল ভালো হয়ছে। কপিলমুনি ইউনিয়নের বিরাশী গ্রামের পুরস্কারপ্রাপ্ত আম চাষি অখিলবন্ধু ঘোষ জানান, বর্তমানে আবহাওয়া অনুকূলে
রয়েছে। কৃষি বিভাগে গিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণ করছি। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও আমাদের বাগানে এসে আমের বাগান ভাল রাখার জন্য বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। পুরোপুরিভাবে শীত বিদায়ের আগেই মুকুল না আসলে ভালো ফলন হবে না। ঘন কুয়াশায় মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদিও ফাগুনে কুয়াশার আশঙ্কা কম তারপরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতির বিরূপ আচারণে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

হরিঢালীর আকবর হোসেন, গদাইপুরের মোবারক ঢালী, তকিয়ার মুজিবর গাজীসহ বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ীরা জানান, ঋণ করে আগাম আম বাগান নিয়েছি। অনেক চাষী আম বিক্রি ঋণের টাকা পরিশোধ করবে। তাই আমের মুকুল বের হওয়া আর ফলনের উপর নির্ভর করছে আম চাষির স্বপ্ন।

কৃষিবিদরা জানান, আম গাছের বহু সমস্যার মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো প্রতি বছর ফুল ও ফল না আসা। দেখা গেছে, একেবারেই ফুল হয় না বা হলেও কোনো কোনো বছর খুব কম হয়। যখন অনেক গাছে এক বছর খুব ফুল হয় আর পরের বছর একেবারেই হয় না বা খুব সামান্য হয় এবং তৃতীয় বছর আবার খুব বেশি ফুল আর চতুর্থ বছর কিছুই না বা কম অর্থাৎ এরা একটু ছন্দের মতো চলে। এই রকম হলে বলা হয় ‘অলটারনেট বা বায়িনিয়াল বেয়ারিং। আবার যেসব গাছে হয়তো এক বছর খুব বেশি ফুল হলো, তারপর দুই তিন বছর হলো না বা কম হলো, কিংবা পরপর দু’তিন বছর বেশ ফুল হলো তারপর এক বছর বা কয়েক বছর বন্ধ থাকে অর্থাৎ এরা একটু এলোপাতাড়ি ধরনের। এদের বলা হয় ‘ইরেগুলার বেয়ারার’। এই দুটি সমস্যা অনেক আম গাছে দেখা যায়। যে বছর খুব বেশি ফুল হয়, সেই বছরটিকে উদ্যান বিজ্ঞানে বলা হয় ‘অন ইয়ার’, আর বিনা ফলন বা কম ফলনের বছরকে বলা হয় ‘অফ-ইয়ার’।

আমের একটি ডালে মুকুল আসতে হলে, ফুল আসার আগে ডালটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা ও নাইট্রোজেন দুই-ই থাকতে হবে আর শুধু তাই নয়, শর্করার ভাগ নাইট্রোজেনের ভাগের চেয়ে যথেষ্ট বেশি থাকতে হবে তবেই মুকুল আসবে। আর যদি দুটির ভাগ সমান হয় বা বিশেষ করে ডালটির নাইট্রোজেনের মাত্রা শর্করার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে ঐ ডালটির ডগায়, বসন্তকালে মুকুল আসার বদলে পাতা এসে যাবে। আম গাছের এই সমস্যাটির জন্য উদ্ভিদ হরমোন ‘অক্সিন’, ‘জিবেরেলিন’ ও বিশেষ করে ‘গ্রোথ
ইনহিবিটর’ জাতীয় হরমোনগুলো দায়ী বলে মনে করা হয়। মাটিতে প্রয়োজনীয় পানিওরসের অভাব হলে সার প্রয়োগের পর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিডার রুটগুলো গাছের গোড়া থেকে দূরে থাকে। যে বছর গাছে প্রচুর ফুল আসে, সে বছর যদি গাছের অর্ধেক ফুল ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে গাছের সেই অংশ নতুন শাখা উৎপন্ন করবে। আগামী বছর সেই অংশে ফুল ও ফল উৎপন্ন করবে।

এভাবে আম গাছ থেকে নিয়মিত ফলন পাওয়া যেতে পারে। বাণিজ্যিক জাত যেমন, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আশ্বিনা
ইত্যাদির অলটারনেট বেয়ারিং হ্যাবিট আছে এবং বারি আম-১, বারি আম-২, বারি আম-৩, বারি আম-৪ ইত্যাদি রেগুলার বেয়ারর জাত। তাই বাগানে শুধু ‘অলটারনেট বেয়ারার’ জাতের গাছ না লাগিয়ে, অন্তত কিছু সংখ্যক ‘রেগুলার বেয়ারার’ জাতও লাগানো উচিত। এতে প্রতি বছরই বাগান থেকে কিছু না কিছু ফলন পাওয়া যাবে। বাগানের গাছগুলোকে অধিক উৎপাদনক্ষম করার জন্য অবশ্যই আম বাগানের মাটি বছরে ৩ বার বর্ষার আগে, বর্ষার পরে ও শীতকালে লাঙল, পাওয়ার টিলার অথবা কোদাল দ্বারা কুপিয়ে ভালোভাবে গভীর চাষাবাদ করতে হবে। ফলে বাগানের আগাছা মারা যাবে এবং মাটির সাথে মিশে জৈবসারে পরিণত হবে। মাটির ভেতরকার পোকামাকড়ও মরে জৈব পদার্থ হিসেবে মাটিতে যোগ হবে। তাছাড়া মাটির আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং পুষ্টি উপাদানগুলো গাছের গ্রহণের উপযোগী হবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, আমাদের পাইকগাছায় ৯০ ভাগ গাছে মুকুল চলে এসেছে, চাষীদের ফুল ফোটার অবস্থায় কোনো ঔষধ বা কীটনাশক ব্যবহার না করতে বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ সময়ে বাগানে হপার এবং ফুলকী পোকাগুলো গাছের বাকলে লুকিয়ে থাকে। এ ধরনের পোকা খুব বেশী দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক নাশক স্প্রে করার পরামর্শ প্রদান করছি। কুয়াশার কারণে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য অনুমোদিত সালফার বা বালাই নাশক স্প্রে’র পরামর্শ দিয়েছি। আবহাওয়া যদি রৌদ্রজ্জ্বল হয় এবং তাপমাত্রা বাড়ে তবে গুটি ভালো হবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here