গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজকালের মধ্যে মিয়ানমার সফরের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। দু’দেশের বিরাজমান দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ও রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে তাঁর এ সফর বলে জানা গেছে। টেকনাফ-উখিয়ার সীমান্ত এলাকার ১০ লাখ জনসাধারণ তাঁর এ সফরের খবরে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সীমান্ত পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা আগ্রাসন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পুশব্যাক ও পুশইনের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। হাজার হাজার একর বনভূমি ও লোকালয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবৈধ বসবাস করে জীবিকার তাগিদে নির্বিচারে ধ্বংস করছে বনজ সম্পদ। স্থানীয় শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। তাছাড়া চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, আদম পাচার, সাগরে জলদস্যূতাসহ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে। তাদের কারণে স্থানীয়রা ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। সীমান্ত এলাকায় কর্তৃত্ব চলছে রোহিঙ্গা নাগরিকদের। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা যথাক্রমে মুসলিম এইড, ইউএনএইচসিআর, এসিএফ, ইসলামীক রিলিফ, হ্যান্ডিক্যাপ, সলিডরিটিজ, টাই, এমএসএফ হল্যান্ডসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাদের সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে জানা যায়, জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার ২টি শরণার্থী শিবিরে ২৭ হাজার রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন বস্তি নির্মাণ করে আরো লক্ষাধিক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ নিষিদ্ধ ঘোষিত আরএসও, আরএনও ও আর্ন্তজাতিক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠন হরকতুল জিহাদ, হিজবুত তাহেরী, আলহারামাইন ও আল্লার দলসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের গোপন তৎপরতা তাদেরকে কেন্দ্র করে চলছে কক্সবাজারে। কক্সবাজারে কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা এজেন্সি এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে বর্মী নাগরিক মাওলানা ছালামত উল্লাহ, হাফেজ ছালাহুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল হামিদ ও মাওলানা শামছুল আলমসহ অসংখ্য বিতর্কিত ব্যক্তি। কক্সবাজারে কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা এজেন্সি এসব ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের উপর কড়া নজরদারী রেখেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া তাদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক ব্যক্তিবর্গ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তৎকালীন ১৯৭৮ সালে জিয়া সরকারের আমলে এদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে। টেকনাফ, উখিয়া, রামু, নাইক্যংছড়ি সীমান্ত অতিক্রম করে এ সময় প্রায় ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে দু’দেশের সফর কুটনৈতিক তৎপরতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময়ে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে সক্ষম হলেও বাদবাকীরা কক্সবাজারের বিভিন্ন বন-জঙ্গলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করে। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯১ সালে সীমান্তের নাফ নদী অতিক্রম করে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮শ’ ৭৭ জন রোহিঙ্গা টেকনাফ, উখিয়া, রামু নাইক্যংছড়ির বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক করে পূর্ণরায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫শ’ ৯৯ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হলেও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ৭শ’ ৬৮ পরিবারে ১৪ হাজার ৭শ’ ৮৬ জন এবং উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ১শ’ ৯৭ পরিবারে ১০ হাজার ২শ’ ৪৮ জনসহ ২৫ হাজার ৩৪ জন নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়ায়  প্রায় ১৭ হাজার, উখিয়ার টিভি টাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় ২ হাজার ৫শ’সহ সর্বমোট ৪৪ হাজার ৫শ’৩৪ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ১৯৯১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ২০ বছরে টেকনাফ-উখিয়ার ২ শরণার্থী শিবিরে ৪৬ হাজার ৭শ’ ৬৫ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। এরমধ্যে মারা গেছে ১০ হাজার ৬শ’ ৩৬ জন। বাদবাকী ৩৬ হাজার ৬শ’ ৩৬ জন রোহিঙ্গা শিশু দু’শরণার্থী শিবিরে বেড়ে উঠছে। শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেয়া এসব শিশু-কিশোর-যুবকরা বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিক দাবী করে বলে বেড়াচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত কতিপয় এনজিও সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের উৎসাহিত করার কারণে এদেশে জন্ম নেয়া উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা প্রকাশ্যে প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে নতুন করে আরো ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে টেকনাফ ও উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে সরকারী বনভূমি দখল করে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করে আসছে। অনেক সময় তাদের উচ্ছেদ করতে গেলে রোহিঙ্গা ও বন কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। উক্ত রোহিঙ্গা প্রথ্যাবাসন তরান্বিতসহ ৭ দফা দাবী সম্বলিত স্মারকলিপি টেকনাফ-উখিয়ার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে প্রেরণ করেছে অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ। এরপরও অদ্যাবদি রোহিঙ্গা প্রতিরোধের চেয়ে অনুপ্রবেশ গাণিতিক হারে বেড়েই চলেছে। গত ২০১০ সালের শুরু থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দু দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক পর্যায়ে একাধিকবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সমপ্রতি আবারো নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের আশ্বাসে সীমান্ত এলাকার জনসাধারণের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যতা দেখা দিয়েছে। তারা আশা করছে প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ সমস্যার সমাধনকি আদৌ হবে!

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবির ও লেদা ভাসমান রোহিঙ্গা বস্তির কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে অনুমিত হয় তারা শর্তসাপেক্ষ প্রত্যাবাসনের পক্ষে। ভাসমান রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থানরত মংডু এলাকার মৃত নূর আহমদের পুত্র মোঃ ছালেহ (৪৫), মৃত কালুর পুত্র মোঃ ইউনুছ (৪৮), মৃত নজির হোছনের পুত্র দিল মোহাম্মদ (৫৫) বলেন, ‘আঁরারে দুঁরাই (প্রত্যাবাসন) দিয়া ন’ফরিব। এড়ে (মিয়ানমারে ) শান্তি অইলে দইজ্জা আঁচুরি যাইয়ুম (নিজেরা নিজেদের ব্যস্থাপনায় নাফ নদী পেরিয়ে স্বদেশে চলে যাবে)। এড়ে আঁরারে ধর্ম গইত্ত ন’দে, মজসিদ ভাঙ্গি জাদি বানাইয়ে, ওগ্গাতুন দু’য়া বিয়া গইত্ত ন’দে, জাগা জমিন হারি ল’ (কেড়ে নেয়), হাঁস-কুরা-গরু-ছ’অল ডঁর অইলে লইযাগই, তারবাদে খাই ফেলা, আঁরার ঘরত ডঁ’অর অইয়া (কিশোরী থেকে বালিকা-যুবতি হলে) সুন্দর-সান্দর মাইয়া-পোয়াইন মগ’র জোয়ান পোয়াইন্দে ইজ্জত হানি গরে। এতল্লা (এ কারণে) আঁরা সহ্য গরি ন’ফারি এদেশত আয় গিয়িগই। ইন বেগ্গুলুন ফাসালা অইলে (এসব অত্যচার-নির্যাতন বন্ধ হলে) আঁরারে দুঁরাই (প্রত্যাবাসন) দিয়া ন’ফরিব।’

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/কামাল আজাদ/কক্সবাজার

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here