রোকেয়া ইসলাম

রোকেয়া ইসলাম :: লাইলিকে ভাল করে না দেখলে বুঝতেই পারতো জীবনে স্বাধীনতা কাকে বলে। লাইলি ছোট খালার ভাসুরের মেয়ে।ওর জীবনযাত্রা এমন বাঁধনহারা সেটা জানা হতো না যদি না খালার আঁচল ধরে এ বাড়িতে আসতো।

খুব সকালে বাড়ির অত্তবড় উঠোন বাইরে অঙ্গন ঝাড়ু দিয়ে। ডোয়ায় হেলান দিয়ে তালা দিয়ে রাখা সাইকেল বিশেষ প্রদ্ধতি খুলে পুরো সড়ক বারদুয়েক চক্কর দিয়ে এসে যেখানকার সাইকেল সেখানে তালা দিয়ে রেখে রান্না ঘর থেকে একপাজা হাড়িপাতিল কুঁয়ারপাড়ে নিয়ে ছাই দিয়ে ঘষে উঠোনের কোণে বাঁশের মাচায় শুকোতে দিতেই উঠোনের তিনপাশের ঘরের দরজা খুলে যায়। বাংলা ঘরের মূল দরজা উঠোনের দিকে নয় সেটার খোলারও শব্দ হয়।
লাইলির দাদি চাল ডাল মেপে দিলে মূল রান্নাঘরের সামনে ফাইল্লা ঘরের দুচুলা জ্বালিয়ে ভাত ডাল বসায়। ততক্ষণে লাইলি যাকে মা বলে ডাকে সে এসে একটা উচু পিড়িতে বসে।

– কি করুম অহন কন
বলে লাইলি সামনে দাঁড়ায়
-শইলডা ম্যাজম্যাজ করতাছে মাজাডা বিষাইতাছে। ভাত অইলে চায়ের পানি দিস। তর দাদির কাছ থিকা এককাঠা মুড়ি নিয়া আয়। চায়ের পানি বেশি কইরা দিস। চম্পারা চা মুড়ি খাইয়া পড়তে বইব।

লাইলি দৌড়ে গিয়ে দাদির কাছে থেকে কাঠা উপচে পড়া মুড়ি নিয়ে মায়ের কাছ দিয়েই
রান্নাঘরে এসে নাকড় দিয়ে ফুটন্ত ভাতের পাতিল থেকে তুলে দেখে। চাল ফুটে ভাত হয়েছে কিনা।
বড় এক পাতিল ভরে চায়ের পানি চুলায় বসায়।

কেটলি ভরে চা ঘরে দিয়ে এসে ডাল বাগার দেয়। কতগুলো গোলআলু চুলায় বসায় ভর্তার জন্য ।বড়রা ততক্ষণে চুলার কাছে আসে।
শায়লার খালা পিরিচে কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট আর এক কাপ শায়লাকে দিয়ে যায়।
শায়লা ফাঁক খুজতে থাকে কখন লাইলির দেখা পাওয়া যায়। এইযে বড় পাতিল ভরে চা বানালো লাইলির কপালে একচুমুক চাও জুটবে না।
লাইলি ভাতের গামলা চম্পাদের ঘরের দিকে যেতেই শায়লার সাথে চোখাচোখি হয়
হাত দিয়ে ইশারা করতেই শায়লার কাছে আসে।

সারা সকাল শক্ত পরিশ্রমের কাজ সারতে সারতে বেচারি একেবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
থপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। শায়লাও ওর কাছ ঘেষে বসে এক হাতে চায়ের কাপ অন্যহাতে বিস্কুট।
– হায় হায় ইষ্টি নিচে বসে ক্যা। চিয়ারে বস।
শায়লা পিরিচে ঢেলে খানিকটা চা আর একটা বিস্কুট ওর হাতে দেয়।

-আইজ কি হইচে শুন চুলায় পানি দিয়া আমি পায়খানায় গেছি। চায়ের পানি হুকাইয়া এতধুল্লা হইয়া গেছে। তাই ব্যাকের চা অইলো না গো।
লাইলির কথায় জবাব দেয়না শায়লা।
আসছে পর থেকেই দেখছে লাইলির সাথে এই বৈষম্য আচরণ।
-নাও এবার একটু জিরাও তো।
-তুমি আমার কথা বিশ্বাস গেলা না
-তুমি শুধু শুধু মিথ্যে বলবে কেন? এবার শুরু কর।

এ বাড়িতে সকালে ভাত দিয়ে নাশতা সারে। খালা ওর জন্য একটা ডিম ভেজে এনেছে। ভর্তা ডাল ডিম ভাজা এক থালা গরম ভাত দিয়ে সকালের খাবার দেয়। সবাই ডাল আলু ভর্তা দিয়ে এক থালা গরম ভাত খেয়েই সকালের খাবারের পালা শেষ করেই যার যার কাজে ব্যাস্ত হবে।
লাইলি মেঝেতে পান্তাভাতের থালা নিয়ে বসেছে।
লাইলিকে কাছে ডাকে শায়লা।
-এসো একসাথে খাই।
লাইলি ওর ভাগের ডিম ভাজা থেকে একটা টুকরো বের করে লাইলি পাতে দেয় সাথে এক খাবলা গরম ভাত।

সবার এঁটো বাসন কোসন ধুয়ে মনের আনন্দে পাড়া বেড়াতে ছুটলো
যেতে যেতে দেখলো সড়কের ঢালে দন্ডোকলসের ঝাড়। সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। লাইলিকে পায় কে। সাথে সাথে ফুলগুলো ছিঁড়ে মধু খেতে শুরু করে।
– ল খাও। এক্কেবারে খাটি মধু।

দন্ডোকলসের সাদা ফুলের মধু খাওয়া শেষ করে পটাপট সবুজ পাতা ছিঁড়ে ওড়নার কোচর ভরে নিয়ে শায়লার হাত ধরে হাঁটতে থাকে।
সড়কের পাশে একটা ইয়া বড় গাব গাছের নিচ দাঁড়ায় ওরা।
-তুমি এইহানে বহ আমি তুমারে একটা জিনিস খাওয়াই।

ওড়নাটা শায়লার কোলের কাছে ফেলে হুড়হুড় মোটা গাছ বেয়ে অনেক উপরে উঠে যায়। চিকন ডালে পা দিয়ে চিৎকার করে ওঠে। “পাইছি ” পাইছি
কি পেলো লাইলি গাছে উঠে। ও কি আর্কিমিডিসের মত কোন সূত্র আবিষ্কার করলো। উপরের দিকে তাকাতেই দেখে লাইলি সরসর করে নেমে পড়ে গাছ থেকে। কামিজের দুই প্রান্ত পাজামার ফিতার সাথে গুজে রেখেছে। সেখানে হাত দিয়ে দুটো পাকা গাব বের করে একটা শায়লাকে দেয় অন্যটা নিজে ভেঙে খাওয়া শুরু করে।

ওকে দেখে শায়লাও খেতে গিয়েই অনুভব করে এই সুস্বাদু ফলটা জীবনের প্রথম খেল শায়লা। বেতবন ঢুকে বেতগাছে ভয়াবহ কাঁটার মধ্য থেকে বেতফল তুলে আনার ভয়ংকর অভিজ্ঞতাও লাইলির সঙ্গে ঘুরতে গিয়েই হয়েছে।
শেষ দুপুরে ঘুরতে গেছে দুজন। ওদের সামনে হঠাৎ বাতাসে অল্পকিছু জায়গা শুকনো পাতা নিয়ে বাতাস ঘুরতে থাকে শনশন শব্দে।
-সর সর এইডা হইলো দানইব্বা বাতাস। ডাইনি বইস্সা দোল খায় আর যার দিকে নজর দেয় তার খুব ক্ষতি কইরা ছাড়ে।
-যা এতো সুন্দর বাতাসে বুঝি ডাইনি থাকে। এই ঘূর্ণি বাতাসটা হলো তুমি।
– আমি!! বাহ ভাল বল্লা তো। আইচ্ছা আমি পাতার নূপুর পইড়া ঘুরতে ঘুরতে উপরে উইডা মিলাইয়া যামুনে।

খালপাড়ে গিয়ে দেখে একদল ছেলে জালিজাল দিয়ে মাছ ধরছে।
শাায়লাকে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে একছেলের কাছে থেকে মাছের ভাগ আধাআধি শর্তে জাল নেয়।
মাছ মারা শেষ হলে সমান ভাগ করে লাইলি। লাইলির ভাগের মাছ ওড়নার আঁচলে বাঁধতে থাকে তখন জালওয়ালা খাবলা দিয়ে বেশখানিকটা মাছ লাইলির কাছ থেকে নেয়।

কেন জিজ্ঞেস করতেই জালের ভাগ বেশি দাবি করে। লাইলিকে গালিও দেয়। সাথে সাথে লাইলি ঝাপিয়ে পড়ে। লেগে যায় মহা হুলুস্থুল।
হাওয়ায় পাঠানো ডাকে ছেলেটির মা এসে লাইলির চুলের মুঠি ধরে পেটাতে থাকে লাইলি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
-ঐ জাউরা মাগি আমার পোলারে তুই মারলি ক্য। তুই ক্যরা আর আমার পুলা ক্যারা ভুইলা গেলি

– না ভুলি নাই আগে তো মনে করতাম আপনের পোলা আবাল অহন দেহি বালপাকনা। আরে তর লগেরডি পারছে নি এতোডি মাছ মারতে। আমি মাইরা দিলাম আর আমার লগে কেদ্দারি করতে আইছে। আপনের পোলা মিছা কথা কয় হ্যারে সত্য কথা শিখাইয়েন।
-ঐ নটির ঘরের নটি তর কাছে শিখতে হইব আমার হাচা মিছা। চম্পার মা তর লগে ঠিক কাম করে। আরে মাগি তরে তো রাস্তার ধার থন কুড়াইয়া আইনা আজহার পাগলা চেয়ারম্যানের কাছে দিছে। কোন কাত্তি মাসের কুত্তা কুত্তির বিগারে জন্মাইছোস তুই। নটির ঘরের নটি।
বলে ছেলেকে নিয়ে ভাগের মাছ নিয়ে চলে যায়।

লাইলি ছটফটে মাছগুলো বেঁধে হাটতে হাটতে সড়কে ওঠে। লাইলির জন্য শায়লার খুব কান্না পাচ্ছে। মিছেমিছি মহিলা ওকে বকা দিল।
হাঁটতে থাকে আবার গাছের তলায় বেশ বড়সড় একটা বাউকুড়ানি। ক্ষেপে যায় লাইলি বসে পড়ে বাউকুড়ানি সামনে
-ওরে শালার বাউকুড়ানিরে কেন তুই বারবার কস আমি কপালপোড়া । জানি তো আমারে যারা জন্ম দিসে তারা পালতে পারে নাই। কুত্তা বিলাইয়ের নাগাল মাইনসের লাত্থি গুতা খাইতাছি আরো খামু। ক্যা আমারে লাত্থিগতা খাইতে হইব আমার কি দুষ? যারা আমারে জন্ম দিসে তাগো চোখে দ্যাহস না ধর তাগো। ল্যাংড়া আতুর কইরা ফালাইয়া থো।
ধুলো উড়িয়ে কাঁদছে লাইলি।

আহারে কোন বুনো বাতাসে দুজন নরনারী সবকিছুকে ঠেলে কাছে এলো। জন্ম নিলো যে শিশু ফেলে গেল তারে। তার বুকে বুনো বাতাস ক্রমশ ঝড় তৈরি হচ্ছে….

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here