টানা পাঁচ দিন ধরে সংসদ অচল। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী অসন্তোষকে সামাল দিতে নাজেহাল মনমোহন সিংহের সরকার। বিপাকে কংগ্রেসও। কিন্তু এই অবস্থার মধ্যেও তারা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে রাহুল গাঁধীকে দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী হিসেবে তুলে ধরার প্রক্রিয়া পুরোদস্তুর শুরু করে দিল। লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রার পরে বিজেপি যখন সরকার বিরোধিতায় আরও আগ্রাসী অবস্থান নিচ্ছে, তখন প্রতি আক্রমণে এ বার রাহুলই হবেন কংগ্রেসের প্রধান মুখ। রাহুলের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সেই অলিখিত সিলমোহরই যেন আজ যুব কংগ্রেসের অধিবেশনে দিয়ে দিল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড।
সাংগঠনিক নির্বাচনের পর যুব কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আজ ও কাল দু’দিন ধরে নয়াদিল্লিতে কনভেনশন ডেকেছেন রাহুল গাঁধী। যে কর্মসূচির পোশাকি নাম ‘বুনিয়াদ।’ কিন্তু নিতান্তই একটি সাংগঠনিক কর্মসূচির মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ রইল এই অধিবেশন? তা যে নয়, কনভেনশনে দল ও সরকারের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিই তা প্রমাণ করে দিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির মতো কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির আধ ডজন নেতা শুধু হাজিরই হলেন না, সকলে মিলে রাহুলের নেতৃত্বে ভরসা ও আস্থার কথা জানিয়ে দিলেন। যুব কংগ্রেসে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও নেতৃত্বে নতুন মুখ তুলে আনার জন্য বাহবাও দিলেন তাঁরা। আগামিকাল অধিবেশনে যাওয়ার কথা মনমোহন সিংহ ও সনিয়া গাঁধীর। এখানেই শেষ নয়। যুব কংগ্রেসের এই অধিবেশনের সময়টিকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। মনমোহন-সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসের মধ্য মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর দলের একটা বড় অংশই নেতৃত্বে পরিবর্তন চাইছেন। তা ছাড়া, উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট আসন্ন। কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, রাহুলের এই ‘উত্তরণ’ উত্তরপ্রদেশে তাঁর প্রচারের ওজন আরও বাড়াবে। হাইকম্যান্ড কিন্তু শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতিতেই রাহুলের গুরুত্ব বাড়াতে সক্রিয়। এবং এ ব্যাপারে হাইকম্যান্ডের মনোভাব স্পষ্ট, আর রাখঢাক নয়, গাঁধী পরিবারের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি এ বার আগ্রাসী ভূমিকায় দলকে নেতৃত্ব দিন।
দলের এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে রাহুলের কাজকর্মেও। উত্তরপ্রদেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের প্রচার শুরুর দিন থেকেই নিজের আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয় তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই যুব কংগ্রেসের অধিবেশনে তার মাত্রা আজ তুলনায় বেশিই ছিল। তবে একমাত্র দুর্নীতির বিষয়টি নিয়েই কথা বলেছেন তিনি। মূল্যবৃদ্ধি বা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের মতো বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় যাননি রাহুল। তাঁর আলোচনায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সংগঠন। তাঁর হাত ধরেই টানা তিন বছর দেশ জুড়ে অভিযানের পরে যুব কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। সাংগঠনিক নির্বাচনের পর বুথ স্তর থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত নেতার সংখ্যা দশ হাজার ছুঁই ছুঁই। এর মধ্যে পঞ্চায়েত সদস্য, পুর প্রধান, বিধায়ক, সাংসদ এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রয়েছেন। কংগ্রেসের ভাগ্য ফেরাতে তাঁর এই ‘সিপাহিদেরই’ আজ উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন রাহুল। পাশাপাশি সর্বভারতীয় কংগ্রেস ও তার যুব শাখার মধ্যে ‘লুপ্তপ্রায়’ সমন্বয় ফেরানোরও কথা বলেছেন।
কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, গোটা দেশে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে কংগ্রেসের জনভিত্তি বাড়ানোই এখন রাহুলের মূল কৌশল। যে হেতু দেশের জনসংখ্যার গড় বয়স এখন অনেক কম। তাই নতুন প্রজন্মের নেতা তৈরি করে তাঁদের মাধ্যমে যুব সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন রাহুল। কংগ্রেসও। আজ সমাবেশেও রাহুল যুব কংগ্রেসের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, “সরকারের সামাজিক প্রকল্পের প্রচার করো। আম আদমি, যুব সম্প্রদায়ের হাত ধরো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ো।” তাঁর কথায়,“ দুর্নীতি রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই ঢুকে পড়েছে। একমাত্র নতুন প্রজন্মই পারে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে তা সমূলে শেষ করতে।” পাশাপাশি যুব নেতাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খাকেও উস্কে দিয়ে বলেছেন,“যুব কংগ্রেস নেতাদের যে সমাবেশ আজ হয়েছে, তাঁরা কেউই বংশ পরিচয়ের কারণে নেতা হননি। সাংগঠনিক নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে এসেছেন।”
যুব কংগ্রেসের এই সমাবেশে যোগ দিয়ে নেতৃত্বে নতুন প্রজন্ম তুলে আনার কথা বলেছেন চিদম্বরমও। কংগ্রেস ও সরকারের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চিদম্বরমই প্রথম যিনি আজ রাহুলের সভায় উপস্থিত হন। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় চিদম্বরম যা বললেন, তা-ও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তাঁর কথায়, “চল্লিশ বছর আগে কলকাতায় যুব কংগ্রেসের এ রকমই এক সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলাম। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ছিলেন তখন অন্যতম আয়োজক। সে দিন সম্মেলনে যোগ দিয়ে মনে মনে এই প্রশ্নটাই উঠেছিল যে, মঞ্চে বসে থাকা বর্ষীয়ানরা কবে নতুন প্রজন্মের উত্তরণের পথ করে দেবেন। আজও তাই মনে করি। বর্ষীয়ানদের উচিত নতুন প্রজন্মের নেতাদের জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া।” রাহুলের নেতৃত্বে আস্থা জানাতে গিয়ে প্রায় একই কথা বলেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিও।
তবু নজর আগামিকালের দিকেই। কারণ কাল সভায় থেকে মনমোহন-সনিয়া এ ব্যাপারে কী বলেন, বিশেষত ছেলের রাজনৈতিক উত্তরণের প্রশ্নে সনিয়া সরাসরি কোনও বার্তা দেন কি না, সেটাই এখন দেখার।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/ইউএন ডেস্ক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here